বৃহস্পতিবার,

২৫ এপ্রিল ২০২৪,

১১ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহস্পতিবার,

২৫ এপ্রিল ২০২৪,

১১ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

বন্যপ্রাণী পাচারচক্রের টার্গেট ‘বেঙ্গল টাইগার’ 

শুভ্র শচীন, খুলনা 

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৯ জুলাই ২০২১

Google News
বন্যপ্রাণী পাচারচক্রের টার্গেট ‘বেঙ্গল টাইগার’ 

দেশের বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা দিন দিন বড় হচ্ছে। গড়ে উঠেছে বন্যপ্রাণীর বিভিন্ন ক্রেতাশ্রেণী। আন্তর্জাতিক পাচারকারীচক্রের কাছে বন্যপ্রাণীর অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএ) বাংলাদেশ এবং ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের (সিসিএ) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীদের একটি বড়অংশের উৎস সুন্দরবন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা। 

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বের প্রতীক সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার রক্ষায় সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে যে যার মতো করে কাজ করছে।
বন্যপ্রাণী রক্ষায় সরকারের নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও বনবিভাগের বন্যপ্রাণী ও অপরাধ দমন ইউনিট চলছে ধুঁকে ধুঁকে। তারা সরকারের অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা ছাড়া বন্যপ্রাণী অপরাধ দমনের কাজে যেতে পারেন না। 

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ভেতরে যেসব বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার হয়, তার  বড়অংশই ধরা পড়ে না। এগুলো বিদেশে পাচার হয়। দেশের প্রায় ১৫টি বেসরকারি চিড়িয়াখানা, অবকাশকেন্দ্র ও বাগানবাড়িতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী এনে রাখা হয়।

বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য দমনে মূল চ্যালেঞ্জ অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় জটিলতা। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুযায়ী, বন্যপ্রাণী নিধন এবং ব্যবসার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৫ লাখ টাকা জরিমানা ও ১২ বছরের কারাদণ্ড। 

বনবিভাগের একাধিক গবেষণায়ও বন্যপ্রাণী পাচারচক্রের প্রধান টার্গেট সুন্দরবনের বাঘ আর বিদেশে পাচারের প্রধান গন্তব্য হিসেবে মিয়ানমার, ভারত ও চীনের কথা বলা হয়েছে। মূলত স্থল, নৌ ও আকাশপথে এসব বন্যপ্রাণী পাচার হয়। জীবিত ও মৃতপ্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচারের সময় বনবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করেছে। 

পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোল ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে ২০১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুন্দরবনের বাঘ হত্যা এবং ক্ষুদ্র অস্ত্রের সরবরাহ নিয়ে দুটি প্রতিবেদন জমা দেয়।

‘বাংলাদেশ সুন্দরবনে বাঘের বাণিজ্য’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৭৬ শতাংশ কমেছে। সুন্দরবনের বাঘ হত্যায় একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয়। পেশাদার বন্যপ্রাণী শিকারী একটি চক্র বাঘ হত্যা করে তা ভারতে পাচার করছে।

ভারত থেকে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আন্তর্জাতিক বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এইচক্র সুন্দরবনে বাঘ হত্যায় অস্ত্র সরবরাহ, হত্যা শেষে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও চামড়া চোরাচালানের কাজ করে। সুন্দরবন-সংলগ্ন এলাকার বেশকয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এ কাজে জড়িত। ইন্টারপোল থেকে এই চক্রের সদস্য হিসেবে ৩২ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরা বাঘ হত্যা করে ছোট্ট নৌকা ও টলারে ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছে দেয়। সেখানে ভারতীয় চোরাচালান চক্র তা কিনে নেয়। সুন্দরবন থেকে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গাড়ি ও মোটরসাইকেলে ঢাকায় এনে সংরক্ষণ করার ঘটনাও ইন্টারপোলের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।


প্রতিবেদনে বলা হয়, সুন্দরবনের বাঘ হত্যা করে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রির মূলত তিনটি বাজার ভারত, মিয়ানমার ও মালয়েশিয়া। এসব বাজার থেকে বাঘের চামড়া ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও পাচার হয়। দেশের ভেতরেও বাঘের হাড়, দাঁত, নখ ও মাংসের একটি অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চীন, মালয়েশিয়া, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ায় কাঁকড়া ও মাছের চালানের সঙ্গে লুকিয়ে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাঠানো হয় বলে ইন্টারপোলের প্রতিবেদনে ধারণা করা হয়েছে। আর এই চালানগুলো হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

দীর্ঘ দুই যুগেরও অধিক সময় সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন খুলনার দাকোপ উপজেলার ঢাংমারীর সীতেশ বাওয়ালী। সীতেশ বলেন, ‘গডফাদার মহাজন’-এর কাছ থেকে অগ্রিম ‘দাদন’ নিয়ে ছদ্মবেশে বনে ঢোকে একশ্রেণীর শিকারী।

এরা সুযোগবুঝে বনে ঢুকে খাদ্যে বিষ অথবা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অথবা ফাঁদ কিংবা বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা করে। তারপর স্থানীয় পদ্ধতিতে চামড়া, মাংসসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে গোপনে ঢাকা-চট্টগ্রামের চোরাচালানিদের ডেরায় পৌঁছে দেয়।

সীতেশ আরও জানান, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জসংলগ্ন গ্রামগুলোতে প্রায় দেড়শ’-এর অধিক সংঘবদ্ধ শিকারীদল রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ববিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ, কয়রা এবং সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলায়। 

সুন্দরবনে কাজ করতে গিয়ে অনেক চোরাশিকারীদের মুখোমুখিও হয়েছেন সীতেশ। ওইসব শিকারীরা তাকে জানিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে একটি বাঘের চামড়ার জন্য তারা দশ থেকে বারো লাখ টাকা পেলেও বিদেশে একটি বাঘের চামড়ার মূল্য এর কয়েকগুণ বেশি। তবে সুন্দরবনের চাঁদপাই এলাকায় রয়েলবেঙ্গল টাইগার হত্যার শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদাত বলেন, সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় প্রথমত. বন থেকে চোরাশিকারি তাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত. পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষা করতে হবে। বনের ইকো সিস্টেমে কোনো একটা অংশে ব্যাঘাত হলে তার প্রভাব বাঘের ওপর পড়ে। বাঘের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়।

খুলনার সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাঘ হত্যা কিছুটা কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। বাঘের প্রধান খাবার হরিণও শিকার করা হচ্ছে। বনের গাছ কেটে বাঘের বসতি হুমকির মুখে ফেলছে কিছু মানুষ।

বিশ্ববাঘ সম্মেলনের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, পৃথিবীর প্রায় ৪০টি দেশের কালোবাজারে বাঘের চামড়া কেনাবেচা হয়। তাছাড়া বাঘের শুকনো মাংস ও হাড়চুর্ণ কাজে লাগছে বুড়ো কোটিপতিদের। তাদের বিশ্বাস, এসব সেবনে নাকি হারানো পৌরুষ ফিরে পাবে তারা!

১৯৬০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে অবৈধভাবে প্রায় ২০০টি বাঘ হত্যার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতসংখ্যা এরচেয়ে বহুগুণ বেশি বলে সীতেশের অভিমত।

তবে এসময় প্রায় শতাধিত বাঘের চামড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হলেও এর গডফাদাররা ধরা পড়েনি। বনবিভাগের কাছেও এ ব্যাপারে কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। 

সুন্দরবনে বাঘের বাণিজ্য বিষয়ে বন অধিদপ্তরের প্রধান বনসংরক্ষক আমীর হোসাইন চোধুরী বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী বিলুপ্ত প্রজাতির উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বন্যপ্রাণীর ধারক ও বাহক হওয়া সত্ত্বেও এখানে বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য ভৌগোলিকভাবে বিস্তৃত। 

সম্প্রতি সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে ২০১৫ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬। ২০১৮ সালের শুমারিতে এই সংখ্যা এখন ১১৪।

বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার রোধে শিকারী ও বনদস্যুদের গ্রেফতারের জন্য বনবিভাগ, র‌্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ড যৌথভাবে কাজ করছে। সুন্দরবনে ঢোকা এবং বের হওয়ার নদী-খালগুলোর মুখে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, দুই হাজারের ওপর খাল রয়েছে আমাদের সুন্দরবনে। এসব খাল পাহারা দেওয়ার লোকবল অপ্রতুল। তারপরও এ অপ্রতুল লোকবল দিয়ে আমরা যতটুকু সম্ভব আইন প্রয়োগ করার চেষ্টা করছি।


 

রেডিওটুডে নিউজ/ইকে

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের