সুদানের বিমান বাহিনীর হামলায় ১ হাজার ৭০০ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু

মঙ্গলবার,

০৯ ডিসেম্বর ২০২৫,

২৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

মঙ্গলবার,

০৯ ডিসেম্বর ২০২৫,

২৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

Radio Today News

তদন্ত প্রতিবেদন

সুদানের বিমান বাহিনীর হামলায় ১ হাজার ৭০০ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু

রেডিওটুডে রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১৩:৫৫, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৩:৫৬, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫

Google News
সুদানের বিমান বাহিনীর হামলায় ১ হাজার ৭০০ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু

সুদানে আবাসিক এলাকা, বাজার, স্কুল এবং আশ্রয় শিবিরে বিমান বাহিনীর চালানো বোমা হামলায় কমপক্ষে এক হাজার ৭০০ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সময় সংগঠিত বিমান হামলার তদন্তে উঠে এসেছে এই তথ্য। সুদান উইটনেস প্রজেক্ট বলছে যে তারা ২০২৩ সালের এপ্রিলে শুরু হওয়া সংঘাতে সামরিক বিমান হামলার সবচেয়ে বড় এবং জানা তথ্যগুলোই একত্র করেছে।

এই তদন্তের তথ্য বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায় যে বিমান বাহিনী জনবহুল এলাকায়ও নির্বিচারে বোমা ব্যবহার করেছে। এ রকম বিমান হামলা কেবল সুদানের সশস্ত্র বাহিনী বা এসএএফ-ই চালাতে সক্ষম।

কারণ এই সংঘাতের অন্য পক্ষ, আধাসামরিক বাহিনী- র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস বা আরএসএফ- এর কাছে কোনো বিমান নেই। তারা ড্রোন হামলার ওপরই নির্ভরশীল।

সুদানের পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে জাতিগত গণহত্যা চালানোর অভিযোগে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়েছে আরএসএফ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগও এনেছে।

"অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং আইন লঙ্ঘনের জন্য আরএসএফকে দায়ী করা হচ্ছে এবং সেটা ঠিক আছে, তবে আমি মনে করি এসএএফকেও তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী করা উচিত," বলেন প্রকল্পের পরিচালনাকারী মার্ক স্নোয়েক।

নির্বিচারে বোমা হামলার অভিযোগে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখোমুখিও হয়েছে সুদানের সামরিক বাহিনী।

এ বিষয়ে এসএএফ এর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও বিবিসির অনুরোধে কোনো সাড়া দেয়নি তারা।

যদিও বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার অভিযোগ অস্বীকার করে অতীতে বাহিনীটি বলেছিল যে, তাদের বিমান হামলা "শুধু বৈধ সামরিক লক্ষ্যবস্তু হিসাবে স্বীকৃত আরএসএফ এর উপস্থিতি এবং ঘাঁটিগুলোতে পরিচালিত হয়"।

সুদান উইটনেস নামের উদ্যোগটি সেন্টার ফর ইনফরমেশন রেজিলিয়েন্স বা সিআইআর এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত যা একটি অলাভজনক সংগঠন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনাগুলো সামনে আনতে কাজ করে। এই প্রকল্পের জন্য তারা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অর্থায়ন পেয়েছে।

বিবিসির হাতে আসা এই প্রতিবেদনের একটি কপি অনুসারে, ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের জুলাইয়ের মধ্যে পরিচালিত ৩৮৪টি বিমান হামলা বিশ্লেষণ করেছে সুদান উইটনেস।

তাদের নথিভুক্ত ঘটনাগুলোতে এক হাজার ৭০০ জনেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং এক হাজার ১২০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

আবাসিক এলাকা সংক্রান্ত ১৩৫টি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে বাড়িঘর এবং বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

৩৫টি ঘটনা পাওয়া গেছে যেখানে বোমা হামলা হয়েছে বাজার এবং বাণিজ্যিক স্থাপনায়, অনেক সময় যখন সেখানে মানুষের ভিড় ছিল। এছাড়া ১৯টি হামলা স্বাস্থ্যসেবা, বাস্তুচ্যুত মানুষের আবাসস্থল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো স্থানেও হয়েছে।

সুদান উইটনেস স্বীকার করে যে তাদের গবেষণা অসম্পূর্ণ, কারণ ফলাফলগুলো মোট হামলার সংখ্যার চেয়ে তথ্যের প্রাপ্যতাকে সামনে আনে। দুর্বল টেলিযোগাযোগ এবং বিশ্বাসযোগ্য উৎস শনাক্ত করতে অসুবিধার কারণে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলো থেকে তথ্য পাওয়া কঠিন।

যদিও তারা এটি বলছে যে, এই তদন্তে একটি কঠোর পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে যার মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর বিমান অভিযানের একটি বিস্তৃত চিত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যা বেসামরিক জনসংখ্যার ওপর হামলার মাত্রা ও প্রভাব সামনে আনে।

"আমরা যদি বলি যে সুদানের সশস্ত্র বাহিনী একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিমান হামলা চালিয়েছে, তাহলে কমবেশি যাচাইযোগ্য ফুটেজে এসএএফ-এর সেই কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা যাবে," মি. স্নোয়েক বলেন।

"তবে এর পরিমাণ খুবই বেশি হবে, কারণ সুদানে এই ধরনের ফুটেজ খুবই ব্যতিক্রমী। তাই আমরা শত শত বিমান হামলার দাবি বিশ্লেষণ করেছি যা একটি বৃহৎ চিত্র তুলে ধরে," বলেন তিনি।

মি. স্নোয়েক বলেন, আবাসিক এলাকা এবং বাজারে বারবার হামলার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মানবিক ও চিকিৎসা সুবিধাগুলোতে বিপুল সংখ্যক কথিত হামলার ঘটনাই প্রধানত দেখা দেয়।

"আমি মনে করি এই ধরনগুলো দৃঢ়ভাবে ইঙ্গিত দেয় যে এসএএফ বেসামরিক হতাহত এড়াতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না," তিনি বলেন।

সুদানে বিদেশি অস্ত্র সরবরাহের ওপর নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান কনফ্লিক্ট ইনসাইটস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাস্টিন লিঞ্চ বিবিসিকে বলেছেন যে, সেনাবাহিনী এবং আরএসএফের মধ্যে লড়াইয়ের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে সুদানের বেসামরিক নাগরিকদের।

"সুদানের সংঘাত আসলে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বিমানশক্তি এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র সামরিক বাহিনীর চেয়ে বেসামরিক লোকদের বেশি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে," তিনি বিবিসিকে বলেন।

সুদান উইটনেস এমন ঘটনাগুলোই তুলে ধরে যেখানে গোলাবারুদ, আঘাতের কারণে সৃষ্ট গর্ত বা শ্রাপনেলের ক্ষতি শনাক্ত করা হয়েছে।

এরকম একটি ঘটনার একাধিক ভিডিও এবং ছবি নিশ্চিত করেছে সুদান উইটনেস যেখানে উত্তর দারফুরের বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য নির্মিত আশ্রয় শিবিরে একটি বিমান থেকে ফেলা অবিস্ফোরিত বোমাসহ একটি গর্ত দেখানো হয়েছে। এর সঙ্গে সুদানের মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রি কর্পোরেশনের তৈরি এসএইচ-২৫০ আনগাইডেড গোলাবারুদের সাথে মিল রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

"এটি এখনো আমার করা সবচেয়ে উদ্বেগজনক কাজগুলোর একটি। কেন অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য একটি শিবিরে বোমা ফেলা হবে? এই এলাকাটি তখন আরএসএফের নিয়ন্ত্রণেও ছিল না এবং সেই হামলার পিছনের যুক্তি এখনো আমাকে বিভ্রান্ত করে," মি. স্নোয়েক বলেন।

আরেকটি হামলায়, সুদান উইটনেস একটি বিরল ভিডিও যাচাই করেছে যা আঘাতের মুহূর্ত ধারণ করেছে, যেখানে বেসামরিক নাগরিকরা আশ্রয় নেওয়ার সময় বিমানের শব্দের পরে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে।

উত্তর কর্দোফান রাজ্যের হামরাত আল-শেখ বাজারে বোমা হামলায় কমপক্ষে ৩০ জন নিহত এবং ১০০ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

আরএসএফ নিয়ন্ত্রিত দারফুরের বিভিন্ন এলাকায় বিমান হামলা চালিয়েছে এসএএফ।

দক্ষিণ দারফুরের নায়ালা শহরটি প্রায়শই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। অভিযোগ রয়েছে, এখানকার বিমানবন্দরটিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সরবরাহ করা অত্যাধুনিক ড্রোনসহ আরএসএফ এর অস্ত্রের প্রধান প্রবেশপথ বলা হয়। যদিও আরএসএফকে সমর্থনের কথা অস্বীকার করেছে আবুধাবি।

এসএএফ বলছে যে তারা সামরিক সরবরাহ লক্ষ্য করেই হামলা চালাচ্ছে।

কিন্তু, সুদান ওয়ার মনিটর, যারা সংঘাতের ওপর নজর রাখে এমন একদল গবেষকের মতে, এত জনাকীর্ণ পরিবেশে সঠিকভাবে আঘাত করার জন্য তাদের কাছে নির্ভুল অস্ত্রের অভাব রয়েছে।

সুদান উইটনেস এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে শহরের কেন্দ্রস্থলে পরিচালিত ধারাবাহিক বিমান হামলা বিশ্লেষণ করেছে, যা হিউম্যান রাইটস ওয়াচও নথিভুক্ত করেছে। তারা আবাসিক এলাকা এবং একটি চক্ষু হাসপাতালের কাছে হামলায় কমপক্ষে ৬৩ জন নিহত হয়েছিল।

গত বছরের অক্টোবরে উত্তর দারফুরের আল-কুমা বাজারে বোমা হামলায় কমপক্ষে ৬৫ জন নিহত এবং ২০০ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

"মার্কেট এবং অন্যান্য বেসামরিক এলাকায় সামরিক বিমান হামলার এই প্রমাণ সুদানের বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রতি স্পষ্ট এবং অগ্রহণযোগ্য অবহেলার বিষয়টি সামনে আনে," ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন।

সুদান উইটনেস প্রজেক্ট ২০২৫ সালের জুলাইয়ের পরেও বিমান হামলা পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রেখেছে। তাদের মতে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উভয় পক্ষই ড্রোন হামলার দিকে ঝুঁকছে।

সুদান যুদ্ধে জড়িত উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।

এই সপ্তাহে আরএসএফ এবং তার মিত্র সুদান লিবারেশন মুভমেন্ট-নর্থের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কর্ডোফান শহরের কালোগিতে একটি কিন্ডারগার্টেন এবং একটি হাসপাতালে ড্রোন হামলার অভিযোগ আনা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে যে, এই ঘটনায় ১১৪ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৬৩ জন শিশু ।

মি. লিঞ্চ বলেন, কেবল বেসামরিক নাগরিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, বিমান যুদ্ধে কোনো পক্ষই সামরিক সাফল্যও অর্জন করছে না।

"খার্তুমের দখল ধরে রাখার জন্য এসএএফ বিমান অভিযান চালাচ্ছে, কিন্তু তাদের বিমান হামলার ফলে অনেক বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং খুব বেশি সামরিক সাফল্য পাওয়া যায়নি," তিনি বলেন।

রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের