বুধবার,

২৪ এপ্রিল ২০২৪,

১১ বৈশাখ ১৪৩১

বুধবার,

২৪ এপ্রিল ২০২৪,

১১ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

মুরাদপুর জংশন 

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক

প্রকাশিত: ১৮:২৯, ১১ ডিসেম্বর ২০২১

আপডেট: ০১:৩২, ১৪ ডিসেম্বর ২০২১

Google News
মুরাদপুর জংশন 

সংগৃহীত ছবি

হেমন্তের শেষ ভাগ। প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা। ঘুর্নিঝড় জাওয়াদ সেই বার্তাকে আরো বেগবান করছে। দুদিন ধরে বর্ষণমূখর প্রকৃতি। প্রকৃতির এই নীরবতায় চারিদিকে যখন সুনশান ভাব তখন একটি  অডিও বার্তায় সবার আড়মোড়া ভেঙেছে। খুব ভোরে ঘুম ঘুম চোখে সোস্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখতে আমারও তেমনটি হলো। অডিওটি শোনার পর শরীরে কিছুটা কাঁপুনি অনুভূত হলো। শরীরের লোমকূপগুলো দাড়িয়ে গেলো। মাথার চুলে যেন মুহূর্তেই খেলে গেলো বিদ্যুৎ। ঘৃণা আর লজ্জায় ভেতরটা কুচকে যেতে লাগলো। কিছুক্ষণ অসাড় হয়ে থাকলাম। কি করবো, কিংবা বলবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। অডিওটি ফেসবুকে শেয়ার দিয়েও আবার তা মুছে ফেললাম। তবে পরে একটি ছোট পোস্টে সবাইকে জানিয়ে দিলাম যে আমিও অডিওটি শুনেছি। লিখলাম ‘অডিওটি শেয়ার করেও ডিলিট করে দিলাম, ভয়ে নয় লজ্জায়’। 

জি প্রিয় পাঠক, এতোক্ষণে নিশ্চয়ই আপানাদের বোঝা হয়ে গেছে কোন অডিও ক্লিপটির কথা বলছি। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রতিমন্ত্রী। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তি। নিন্দা আর ঘৃণায়ও জনগণের বিশেষ প্রিয়পাত্র তিনি। এই নিন্দা আর ঘৃণার মাত্রা এতোটাই বেড়েছে যে নিজ দলের কর্মী-সমর্থক বলে এতোদিন সোস্যাল মিডিয়ায় তাকে সমর্থন দিতে দেখতাম আজ তারাও তাকে ঘৃণা করছেন। কেউ কেউ মন্ত্রিসভা থেকে প্রত্যাহারে দলীয় প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। 

ডা. মুরাদ হাসান। মধ্যরাতের ভোটে জামালাপুরের একটি আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছেন। তারপর ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে প্রধানমন্ত্রীর দয়ায়। পেয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর পদ। এই পদে থেকেও অনেকদিন পর্যন্ত দেশের মানুষের কাছে খুব পরিচিতি ছিলোনা তার। তবে সম্প্রতি সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ইস্যুতে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে একটি অনলাইন টকশোতে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন মুরাদ। ওই বক্তব্য জিয়া পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এমনসব কথা তিনি বলেন যা শুনে বিস্মিত হয়েছেন কোটি কোটি মানুষ। প্রশ্ন উঠেছে তিনি যে ভাষায় কথা বলেছেন এই ভাষায় একজন নির্বোধও কি কথা বলতে পারে, এই প্ল্যাটফর্মে? যদি না পারে তবে সাংবিধানিকভাবে একজন শপথগ্রহণকারী মন্ত্রী কি করে এমন কথা বলেন? নূন্যতম রুচিবোধ, শিষ্টাচার কিংবা সাধারণ জ্ঞান থাকা মানুষ সামাজিক প্ল্যাটফর্মে এমন কথা বলতে পারেন না। কেননা তিনি জানেন তার এই কথাগুলো মুহূর্তেই পৌঁছে যাচ্ছে কোটি মানুষের কাছে। এর মধ্যে তার মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানরাও থাকতে পারেন। তাই যে কথাগুলো ব্যক্তি নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বলতে পারেন না সেই কথাগুলো সামাজিক মাধ্যমেও বলা যায় না। 

ডা. মুরাদ আওয়ামী রাজনীতিতে খুব বেশি দিনের নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির এক তরফা নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের শরীক দল থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এরপর তিনি গত নির্বাচনে সরাসরি নৌকার টিকেট বাগিয়ে নেন। ঠাই পান মন্ত্রিসভায়। তিনি মন্ত্রিপরিষদে ঠাই পাবেন সেটি কখনো ভাবেন নি। তাই তার নামটি শর্ট লিস্টে আসার পর ফোন করে এক সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘আমিতো হয়ে গেছি। আমিতো মন্ত্রী হয়ে গেলাম। এই কথা বেশকিছুদিন আগে আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে শোনা। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে একসময় ছিলো ওই বন্ধু। গুলশানের এক আড্ডায় বিষয়টি বলেছিলো সে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন তিনি ছাত্র জীবনে ছাত্রদলের রাজনীতিতে পদধারী ছিলেন। পরে আওয়ামী লীগে গিয়ে তার পদস্খলন ঘটে। 

বর্তমানে দেশে রাজনীতিতে এক ধরণের দেউলিয়াপণা চলছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য নেই। জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো অতীত সম্পর্ক নেই। ফলে জনগণের ভাষা বুঝে কথা বলার মতো প্রজ্ঞা ও জ্ঞান কোনোটিই নেই। তাদের দ্বারা জনগণের ভাগ্যের উন্নয়নতো দূরের কথা দেশের কোনো উন্নয়ন হচ্ছেনা। তারা কেবল নিজেদের উন্নতিতে কাজ করে। অবৈধ অর্থ উপার্জন আর ভোগ বিলাসিতায় জীবনটাকে ভাসিয়ে দিয়ে সময় পার করতে ব্যস্ত তারা। ক্ষমতার এই জীয়ন কাঠিরও যে একটা মেয়াদ থাকে সেটি তারা বেমালুম ভুলে যান। 

দেশে রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ এখন কেবলই আওয়ামী লীগ। তাই এ দলটির নেতাকর্মীদের কাছে ক্ষমতাই প্রধান এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনে তারা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছে। কখনো কখনো সেই প্রতিযোগিতা হচ্ছে অসুস্থ, আত্মঘাতি। মূলত দেশের বিরোধী পক্ষগুলোকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আওয়ামী লীগে নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি ডেকে আনছে। এই ক্ষতি কখনো দৃশ্যমান হচ্ছে আবার কখনো অদৃশ্য থেকে যাচ্ছে। এই অদৃশ্যমান ক্ষতির ভেতর ডা. মুরাদের মতো লোকদের মন্ত্রী হওয়া। আর এমন লোক যখন মন্ত্রী হয় তখন সে ক্ষতি দলকে ছাড়িয়ে জাতিকে গ্রাস করে। প্রজন্মের মন-মননে বিরুপ প্রভাব ফেলে আমাদের সমাজকে করে কলুষিত। এটি জাতীর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি। 

এই লেখাটি যখন লিখছি তখন গণমাধ্যমের সর্বশেষ খবরে বলা হচ্ছে প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামীকালের (মঙ্গলবার) মধ্যে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। বিগত এক যুগের মধ্যে এ ধরণের ঘটনা এটাই প্রথম ঘটলো। এর আগে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে কোনো কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠলেও তা হয়নি। তাই সাধারণ জনগণ ধরেই নিয়েছিলো যে এবারও হয়তো স্বপদেই বহাল থাকবেন ডা. মুরাদ। মাঝখান দিয়ে জনগণ কিছুদিন এ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। এর আড়ালে ঢাকা পড়বে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি। এর চাপে হারিয়ে যাবে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। এমন অনেক ভাবনাই ছিলো। তবে শেষ মুহূর্তে তেমনটি হয়নি। সরকার তাকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকার প্রধানের এই সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষকে খুশি হতে দেখা গেছে। অনেকে এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন।  

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবকিছুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রিক। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকাঠামোর একটি স্তর বিন্যাস থাকলেও সেটি আমাদের দেশে কখনোই খুব একটা কার্যকর হতে দেখা যায়না। এখানে উচু থেকে নীচু পর্যন্ত প্রত্যেকটি স্তরে নির্ধারিত দায়িত্বশীল থাকলেও সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ কিংবা নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। তাকে সাবির্কভাবে সবকিছুর দেখাশুনা করতে হয়। তাই কোনো হত্যাকান্ড ঘটলে কিংবা কোথাও আগুন লাগলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বলতে শোনা যায় বিষয়টি আমাদের প্রধানমন্ত্রী পর্যবেক্ষণ করছেন এবং এ খুনিদের ধরতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দিয়েছেন। এভাবে প্রায় সবগুলো সেক্টর থেকেই দায়িত্বশীলদের এমন বক্তব্য জনগণের মনে এই ধারণা দেয় যে, দেশে আসলে কেউ কোনো কিছুই করতে পারেন না যদি না প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন। তাইতো সকল প্রশংসা কিংবা স্তুতি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য। যেহেতু সকল ভালো কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীই একমাত্র স্তুতিবাক্য শোনার যোগ্য তাই রাষ্ট্রে যখন কোনো খারাপ কাজ সংঘটিত হয় কিংবা কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী কিংবা আমলা খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়েন তখন নিন্দা কিংবা কটুবাক্যও স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রীকে সইতে হয়। তাই প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের এই ধরনের ইসলাম বিদ্বেষী বক্তব্য থেকে শুরু করে সর্বশেষ অডিও ক্লিপ নিয়ে জনগণের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাতে পরোক্ষভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই দায় নিতে হয়েছে। তার ওপর গিয়েই পড়েছে পাবলিকের যাবতীয় কটুবাক্য।  

দেহের কোনো অংশে পচন ধরলে সেখানে মশা-মাছি বসে। দগদগে ঘায়ের ওপর সে মশামাছি পড়লে শরীরে যন্ত্রণা আরো বেড়ে যায়। সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে পচন ধরলে মুরাদদের মতো উন্মাদ কীটগুলো সেখানে বসে সে পচনকে আরো বাড়িয়ে দেয়। দগদগে ঘা আর সারেনা। অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, সুশাসনের অভাব, অবাধ দুর্নীতিসহ নানা কারনে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থার পচন আজ দৃশ্যমান। এই অবস্থায় এইসব নীতিভ্রস্ট ডাস্টবিনের মাছিগুলো সে পচন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই কেবল মন্ত্রিসভা থেকে তাদের তাড়ালেই পচন রোধ করা সম্ভব নয়। এদের রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। 

এই কেলেঙ্কারির পর অবস্থা বেগতিক দেখে সোমবার দুপুরে পালিয়ে চট্টগ্রামে চলে যান মুরাদ হাসান। সেখানে এক বন্ধুর বাসায় উঠার কথা থাকলেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, তার ব্যবহৃত ফোনটি বন্ধ। তাই তাদের কাছে কোনো খোঁজ নেই। তবে সে যেখানেই থাকুক প্রয়োজনে এইসব বিকৃত মানসিকতার লোকদের খুঁজে বের করে তারপর জড়ো করতে হবে মুরাদপুর জংশনে। তারপর একটি বৈদ্যুতিক ট্রেনে চাপিয়ে পাঠিয়ে দিতে হবে কালাপানির দেশে। সেই ট্রেনে এইসব পাগল নাচবে, গাইবে একসময় পৌঁছে যাবে জনমানবহীন কোনো স্টেশনে। যেখান থেকে তারা আবারো এই সুজলা-সুফলা, শষ্য-শ্যামলা বাংলায় ফিরে আসতে চাইবে। কিন্তু ফিরতি কোনো ট্রেন থাকবেনা। 
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস/ইকে

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের