বৃহস্পতিবার,

২৫ এপ্রিল ২০২৪,

১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহস্পতিবার,

২৫ এপ্রিল ২০২৪,

১২ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

খুনির কান্নার ধ্বনি শুনতে কি পাও...

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২০:১১, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১

আপডেট: ০০:০৯, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১

Google News
খুনির কান্নার ধ্বনি শুনতে কি পাও...

প্রতীকী ছবি

বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার রায় ঘোষিত হলো গত ৮ ডিসেম্বর। রায়ে ২৫ আসামীর মধ্যে ২০ জনকে ফাঁসি এবং বাকি ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি অনেক বড় ঘটনা। রায়টি এমনই এক সময় দেওয়া হলো যখন দেশে আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে রয়েছে। যার রেশ এখনো শেষ হয়নি। গেল সপ্তাহে এ নিয়ে লেখা আমার ‘মুরাদপুর জংশন’ নামের কলামটিতে এ বিষয়টি তুলে আনার চেষ্টা করেছি। তবে আজকের লেখাটি আবরারকে নিয়ে লিখবো। কেননা এতোবড় একটা ঘটনা নিয়ে দু’কথা না লিখলে নিজেকে অনেক দোষী বলে মনে হবে। আফসোস থেকে যাবে। 

বুয়েটে দেশের সবচেয়ে মেধাবীরাই পড়ে থাকে। তাই অনেকের মতো আবরারকে মেধাবী বলে উল্লেখ করে অন্যদেরকে অ-মেধাবী বলার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অনেক গণমাধ্যম যেমনটি বলে বা লিখে থাকে আমি তেমনটি করতে চাই না। কেননা তার হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে যেসব ছেলেগুলোর ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো তারাও নি:সন্দেহে মেধাবী। এদের মধ্যে অনেকে হয়তো ভর্তি পরীক্ষায় আবরারের চেয়েও ভালো করেছিলো। হয়তো অনেকেই তার চেয়ে দামি বিষয়েও পড়ে থাকবে। তাই শুধু আবরারের নামের সাথে মেধাবী শব্দটি যুক্ত করে অন্যদের মেধাকে খাটো করে দেখতে চাই না। 

২০১৯ সালের নারকীয় ওই হত্যাকান্ডের পর সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক অনেক গণমাধ্যমে বিষয়টি ফলাও করে প্রচার হয়। সেই থেকে এ মামলার রায় নিয়ে জনগণের আগ্রহ ছিলো। বিশেষ করে হত্যাকান্ডের শিকার আবরারের কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট ঘুরেফিরেই অনেকের ওয়ালে স্থান পায়। সে পোস্টগুলোতে একইসঙ্গে দেশপ্রেম ও বর্তমান সরকারের বিতর্কিত কর্মকান্ডের সমালোচনা উঠে আসে। সেদিনের সেই কাল রাতে আবরারের খুনি ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার নেতাকর্মীরা তাকে নির্যাতন চালানোর সময় এই বিষয়টি নিয়েই তাকে জেরা করে। তাকে শিবির এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। প্রায় সারারাত ধরে দফায় দফায় পেটানোর পর পুলিশে খবর দিয়ে তার লাশ নামিয়ে দেওয়া হয় স্বপ্নের ক্যাম্পাস বুয়েট থেকে। 

রায়ের দিন আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে আরো হাজির হয়েছিলেন দন্ডপ্রাপ্তদের বাবা-মাসহ অন্যান্য আত্মীয়রা। রায়ের পর সেখানে আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ কেঁদেছেন। ছেলেকে আর কোনোদিন ফিরে পাবেন না এই নির্মম সত্যকে মেনে নিয়ে অঝোরে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছেন তিনি। বলেছেন, দেশের আদালতে ছেলে হত্যার বিচার তিনি পেয়েছেন। এখন যতদ্রুত এই রায় কার্যকর হবে তত দ্রুতই শেষ হবে তার অন্তর জ্বালা। ছেলে হারানোর বেদনায় সেদিনের সেই কান্নায় কিছুটা হলেও স্বস্তি ছিলো। তিনি দীর্ঘশ্বাস নিয়েছেন। ধন্যবাদ জানিয়েছেন দেশের বিচার বিভাগকে। 

এদিকে এদিন কেঁদেছেন খুনিদের বাবা-মায়েরাও। আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত সেইসব বাবা-মায়ের রোদন ছিলো আরো ভয়ঙ্কর। আরো বেদনাবিদুর। মায়েদের বুকফাটা আর্তনাদ আর বাবাদের হৃদয় ভাঙা হাহাকারে কেবল আদালত প্রাঙ্গণই নয়, পুরনো ঢাকার আকাশে জমেছিলো কালো মেঘ। টেলিভিশনগুলোয় সেসব মায়েদের কান্না আমাকেও ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। 

একটি বিষয় অন্তত সবারই জানা যে, আমাদের দেশের বুয়েট-মেডিকেল থেকে শুরু করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করে তার সিংহভাগই এদেশের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। গ্রাম আর মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা এসব ছেলে-মেয়েরা পরিবারের একেকটি স্বপ্ন, একেকটি জ্বলজ্বলে ভবিষ্যত। সারা জীবনের কষ্ট-পরিশ্রম আর আকঙ্খার মিশেলে গড়া এইসব ছেলে-মেয়েরা যখন বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পায় তখন আর তাদের আনন্দের শেষ থাকেনা। খুশিতে কেঁদে ফেলেন। বিশেষ করে মায়েরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে কেঁদে বুক ভাসান। এই কান্না খুশির। এই কান্নায় মিশে থাকে সন্তানের স্বপ্ন পূরণে তাদের পরিশ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন।

সেদিন ফাঁসি কিংবা যাজ্জীবন রায়ের পর পুলিশের প্রিজন ভ্যানে ওঠার আগে ও পরে দন্ডিত অনেকেই কেঁদেছে। বাবা-মা ছোটো ভাই-বোনদের সামনে থেকে পুলিশী প্রহরায় প্রিজন ভ্যানে ওঠার সময় তাদের সে কান্না বাবা-মায়ের কান্নাকে আরো বেগবান করেছে। সৃষ্টি হয়েছে এক বেদনা বিদুর পরিবেশের। ত্রিপক্ষীয় এই কান্নার অর্থ একেকজনের কাছে নিশ্চয়ই একেক রকম। কিন্তু সব কান্নারই একটি লুকায়িত শক্তি রয়েছে আর তা হলো- নিজেকে হালকা করে, আর অপরকে ভারী করে তথা বেদনাহত করে। তাই তাদের সম্মিলিত কান্নায় দেশের আপামর জনতার মন ভারী হয়েছে। আফসোস আর করুনা ঝরে পড়েছে। যদিও এই আফসোসও একেকজনের প্রতি একেক রকম হয়। 

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি একটি কঠিন সময় পার করছে। জাতীয় রাজনীতির মতো এখানেও একচেটিয়া আধিপত্য চলছে প্রায় এক যুগ। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির কারনে অতীতেও আমাদের দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে অসংখ্য খুনের ঘটনা ঘটেছে। অকালে ঝরে গেছে কত স্বপ্ন। কত বাবা-মায়ের বুক খালি হয়েছে তার হিসাব মেলা ভার। ছাত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির বেশিরভাগই সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে ক্যাম্পাস গুলোয় ছাত্রলীগের একক আধিপত্য থাকায় সংঘর্ষ হচ্ছেনা। যা হচ্ছে তা হলো পরিকল্পিত  হত্যাকান্ড। যার বেশির ভাগ শিকারই আবরারের মতো সমালোচক, দেশপ্রেমিক।  

সম্প্রতি খুলনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-চুয়েটের অধ্যাপক সেলিম হোসেন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন। তাই এই মৃত্যুকে ঘিরে এখনো ছোট্ট এই ক্যাম্পাসটি অস্থির সময় পার করছে। মৃত্যুকে হত্যাকান্ড হিসেবে উল্লেখ করে ক্যাম্পাস শাখা ছাত্রলীগকে দায়ী করা হচ্ছে। তার মৃত্যুর দিন ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী তাকে অপদস্থ করেছে। ক্যাম্পাসে অনৈতিক সুবিধায় টান পড়ায় সেলিম হোসেনের ওপর ক্ষিপ্ত ছিলো তারা। তাই শিক্ষককে তুলে নিয়ে যাওয়াসহ নানা হুমকি-ধমকি দেয় তারা। ছাত্রদের এমন আচরণে এতোটাই বিপর্যস্ত হন সেলিম হোসেন যে দুপুরে বাসায় গিয়ে বাথরুমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঢুকলেও আর বের হতে পারেননি। বাথরুমে যাওয়ার আগে ছাত্রদের দ্বারা অপদস্থ হওয়ার কথা সংক্ষেপে স্ত্রীকে বলেছিলেন তিনি।

সেলিম হোসেন অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের সন্তান। বাবার সঙ্গে নিজে বাজারে গিয়ে সবজি বিক্রি করেছেন। মেধাবী ভাইকে পড়াতে বোনেরা গার্মেন্টসে চাকুরি করেছেন। ভাই তাদের কষ্টের মূল্য দিয়েছেন। শিক্ষক হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে হয়েছেন অধ্যাপক। দায়িত্ব নিয়েছিলেন একটি আবাসিক হলের প্রাধ্যক্ষেরও। সৎ-সাহসী আর দেশপ্রেমিক সেলিম হোসেন বাঁচতে পারেননি। না, তাকে আবরারের মতো পিটিয়ে মারা হয়নি। মানসিক নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুর সঙ্গে অনেকগুলো স্বপ্নে মৃত্যু হয়েছে। তার সন্তানরা এতিম হয়েছে। স্ত্রী বিধাব হয়েছেন। বৃদ্ধ বাবা-মা নির্বাক আর অসহায় হয়ে পড়েছেন। আর সেই দুটি বোন, যারা ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাতে গার্মেন্টসে চাকুরি নিয়ে নিজেদের পড়াশুনা এগিয়ে নিতে পারেননি তাদের যে কি খোয়া গেল সেটি প্রকাশের ভাষা আমার জানা নেই। টাকার অংকে তাদের ক্ষতির কোনো পরিমাপ হয় না। এই ক্ষতি বিবেক দিয়ে পরিমাপ করতে হয়। সেই বিবেক নিশ্চয়ই ওইসব খুনিদের নেই। এই দুটি দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক সময়ের। এর বাইরে অনেক ঘটনা রয়েছে যা সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের অস্তিত্ব বিলীনেরও দাবি রাখে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। কেননা আমাদের দেশের ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রদের অধিকার আদায়ের সহায়ক শক্তির বিপরীতে ভয়ানক শক্তি হিসেবে কাজ করে। যার জলন্ত দৃষ্টান্ত নিকট অতীতের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার কয়েকটি ঘটনা দেখলেই পাওয়া যায়। 

পবিত্র কোরআনের সূরা ইনফিতারে ‘ ইন্নাল আবররা লাফী নাঈম, অ-ইন্নাল ফুজ্জারা লাফী জাহিম’। প্রথম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আবরার তথা সৎকর্মশীলদের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। তার প্রতিশ্রুতি জান্নাতে সৎকর্মপরায়নরা সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকবে। অপর আয়াতে ফুজ্জার তথা পাপীদের শাস্তির কথাও বলেছেন আল্লাহ সুবাহানাহু ও-তায়ালা। তিনি বলছেন, আর নিশ্চয় অন্যায়কারীরা থাকবে প্রজ্জ্বলিত আগুনে। 

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি নিশ্চয়ই আবরার ফাহাদ ও সেলিম হোসেনরা সৎকর্মশীলদেরই অন্তর্ভূক্ত হবেন। পক্ষান্তরে তাদের খুনিরা অবশ্যই অবশ্যই পাপী। সুতরাং আজকে তাদের অনুশোচনার কান্নায় কোনো লাভ নেই। তাদের আজকের এই কান্না আরো লক্ষ্য কোটিগুণ বেড়ে যাবে শেষ বিচারের দিন। সেদিন জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপিত হবে তারা। অনন্তকালের সেই অগ্নিবাষ্পে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হতে থাকবে। আর জান্নাতে বসে সেই কান্নার ধ্বনি শুনতে পাবেন আবরার ফাহাদ ও সেলিম হোসেনের মতো সৎকর্মশীলরা। 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস/ইকে

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের