শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪,

১৫ চৈত্র ১৪৩০

শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪,

১৫ চৈত্র ১৪৩০

Radio Today News

ওয়াজ মৌসুমের হাল-হকিকত

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ১৮:১০, ২৪ ডিসেম্বর ২০২১

Google News
ওয়াজ মৌসুমের হাল-হকিকত

ফাইল ছবি


শীতকাল চলছে। দেশের কোথাও কোথাও শৈত্যপ্রবাহ শুরু হলেও রাজধানী ঢাকায় শীতের প্রকোপ এখনও তেমন নয়। বিশেষ করে আমরা যারা মিডিয়াকর্মী তাদের শরীর এখনও ঝরঝরে। এই একটু-আধটু শীতে আমাদের শরীরে কাঁপুনি ধরে না। দেহের অস্থি-মজ্জা অসাড় হয় না। নিত্য-নতুন গরম খবর আমাদের শরীরকে চাঙ্গা রাখে, মনন প্রকোষ্ঠ গরম হওয়ার পাশাপাশি এ খবরে গরম থাকে আমাদের মিডিয়াপাড়া। 

শীত মৌসুম মানেই আমাদের দেশে ওয়াজ মৌসুম। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই ধারা চলে আসছে। ভৌগলিকভাবে আমাদের দেশের অবস্থান নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের হওয়ায় তাপমাত্রার সর্বনিন্ম যে স্তর তাতেও এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা থেমে থাকে না। এ মৌসুমে বৃষ্টিপাত থাকে না। তাই খোলা প্রান্তরে মানুষের জমায়েত নিরাপদ হয়। কাজের চাপও তুলনামূলক কম থাকে। কোনোপ্রকার অস্বস্তি ছাড়াই একসঙ্গে মানুষ গাদাগাদি করে বসে থেকে ওয়াজ শুনতে পারে। এমন নানা কারনে এ মৌসুমকেই ওয়াজ মৌসুম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। 

ইন্টারনেটের এ যুগে এসে ওয়াজ শোনার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। সেটি ময়দানে যতটা না তার চেয়ে বেশি ভার্চুয়াল মাধ্যমে। ইউটিউবে গিয়ে অসংখ্য বক্তার ওয়াজ শুনে থাকে মানুষ। এদের মধ্যে অনেক বক্তার গরম ওয়াজে অনেকের দিল নরমও হয়। লাখ লাখ ভিউয়ার সেই ওয়াজ যে শোনেন তাতে বক্তা যেমন খুশি তেমনি খুশি ইউটিউবারও। তাইতো মোটামুটি পরিচিত কোনো বক্তার মাহফিল হলেই সেখানে এখন অসংখ্য ক্যামেরা দেখা যায়। যারা এই ওয়াজ ভিডিও করে এটা দিয়ে ব্যবসা করে থাকেন। যাদের ওয়াজের ভক্ত যত বেশি বক্তা হিসেবে ওয়াজের মাঠে তাদের কদর ততো বেশি। আজকের লেখাটি যাকে উপলক্ষ্য করে সেই মাওলানা ইলিয়াসুর রহমান জিহাদি তাদেরই একজন। 

সম্প্রতি খবরে দেখলাম, জিহাদী হুজুর ঠাকুরগাঁওয়ের একটি মাহফিলে ওয়াজ করার কথা বলে ৫০ হাজার টাকা অগ্রীম নিয়েছেন। কিন্তু তিনি মাহফিলে যাননি। পরে এলাকাবাসী জিহাদী সাহেবের এমন কর্মকান্ডের বিচার চেয়ে মানববন্ধন করেছেন। মানববন্ধনে একজন মুরুব্বী আক্ষেপের সুরে বলছেন, ‘জিহাদী হুজুর আসার কথা বলে টাকা নিয়েও আসেননি। একজন আলেম যদি এমন করেন তাহলে আমরা কার কাছে যাব। কাকে বিশ্বাস করবো’!

এর আগে এই ঘটনা নিয়ে একটি অডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। সেখানে আয়োজক কমিটির কোনো একজন অগ্রীম টাকা নিয়েও না আসার কারন জানতে চাইলে জিহাদী সাহেব উত্তেজিত হয়ে ওই লোককে খারাপ ভাষায় গালাগাল করেছেন বলে শোনা গেছে। অডিওটির নিচে অসংখ্য কমেন্ট এসেছে যেগুলো জিহাদী সাহেব পড়ে থাকলে তার লজ্জায় মরে যাবার কথা। তবে আশার খবর তিনি সেগুলো পড়েননি। কেননা এখনো জিহাদী সাহেবকে নিয়ে কোনো দু:সংবাদ চোখে পড়েনি। 

ইলিয়াসুর রহমান জিহাদী। নামেই যার জোশের পরিচয়। ইউটিউবে ওনার ওয়াজ ঘেটে দেখেছি। চিৎকার চেচামেচি আর কিছুটা অশ্লীল অশোভন ভঙ্গি মিশ্রিত ওয়াজ। এইসব মানুষ শোনে। জিহাদী নাম নিয়ে ওয়াজের মাঠে কেন্দে কেন্দে বুক ভাসান। অথচ অডিওতে শোনা তার মুখের ভাষা এবং অগ্রীম টাকা নিয়েও ওয়াজে না গিয়ে ওয়াদা খিলাফ করায় তার ভেতরের ইখলাস-ঈমানের যে দীনতা ফুটে উঠেছে তাতে আমি শঙ্কিত। এই জিহাদ লইয়া ইসলাম কি করিবে, এই ভেবে আমি আতঙ্কিতও বটে। যারা মাহফিলের স্টেজে মানুষের সামনে এক প্রকার চেহারা দেখান অন্যদিকে নিজের কলবের ভিতরে আরেক ধরণের চেহারাকে ধারণ করেন তাদের ওয়াজে আর যাই হোক মানুষের অন্তরের কালিমা দূর হতে পারেনা। 

অন্তত দুই দশক আগে একবার বাড়ির পাশের ঈদগাহে আমরা সমবয়সীরা ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করেছিলাম। তখনকার সময়ে প্রযুক্তির ব্যবহার না থাকায় আজ তার প্রমান হয়তো নেই। কিন্তু কথা সত্যি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান-চাল কালেকশন করে মেলানো সেই ওয়াজের প্রধান বক্তার হাদিয়া ছিলো ৫০০ টাকা। তবে সেই টাকাও তিনি নেননি। কেননা প্রধান বক্তার আলোচনার মধ্যখানেই ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে। ফাঁকা মাঠে প্যান্ডেল তাই শ্রোতামন্ডলীর সঙ্গে সঙ্গে বক্তা এবং আয়োজক কমিটির লোকজনও দৌড়ে নিরাপদে চলে আসি। সে সময় ওয়াজের মাঠের সভাপতি আমার শ্রদ্ধের পিতার কাছ থেকে প্রধান বক্তা হাদিয়া নেবার সময় ৩০০ টাকা গ্রহণ করেন। বক্তার ওয়াজ আমি আগে শুনেছিলাম। তাই এই হাদিয়া তার জন্য সামান্য মনে হয়েছিলো। কিন্তু বক্তা হাসিমুখে ২০০ টাকা ছেড়ে দিয়ে পরদিন সকালে বাড়ির পথ ধরেন।

জানিনা সেই মাওলানা সাহেব এখনও বেঁচে আছেন কি না। কিংবা বেঁচে থাকলেও এখনকার সময়ের বক্তাদের ওয়াজ শোনেন কি না। আর শুনলেও তাদের হাদিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন কি না। আমার মনে হয় সবকিছু জেনে থাকলে উনি আফসোস করবেন। মনে মনে বলবেন, ‘মাওলানা সাহেব তুমি বড় ভুল সময়ে এ ধরাধামে এসেছিলে। আল্লাহ তোমাকে জ্ঞান দিয়েছিলো, কণ্ঠ দিয়েছিলো কিন্তু দুর্ভাগ্য মানুষকে প্রযুক্তি জ্ঞান দেননি। তাইতো না পেলে নামের খ্যাতি, না চিনলে টাকা। আফসোস হে মাওলানা, আফসোস !

গত এক দশকে দেশে এ ধরণের মাহফিলের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুন। করোনার কারনে গত বছরে কিছুটা কম হলেও এ মৌসুমে পুরোদমে শুরু হয়েছে ওয়াজ মাহফিল। এলাকার এমন কোনো মসজিদ, মাদরাসা নেই যারা নিয়ম করে প্রতি বছর ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করছে না। আয়োজক হিসেবে মসজিদ কমিটি কিংবা তাদের সঙ্গে এলাকার যুব সমাজ নামের একটি বিষয় কমন হিসেবে দেখা যায়। মূলত স্থানীয় কিছু যুবক মিলেই এই আয়োজন করে থাকে। এই আয়োজনের পেছনে যতটা না আল্লাহকে রাজিখুশি করার চেতনা কাজ করে তার চেয়ে বেশি থাকে সামাজিক নেতৃত্বে অংশগ্রহণের মনোভাব। এর পাশাপাশি টাকা পয়সার বিষয়টিও থাকে কারো কারো মধ্যে। মাহফিল উপলক্ষ্যে এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি করে এই কথিত ঈমানী চেতনাধারী যুব সমাজ। তারপর খরচ-খরচা করে যা থাকে সেগুলো নিয়ে নানা কেচ্ছা কাহিনী চলে। কখনো কখনো বেঁচে যাওয়া টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারায় সমস্যা দেখা দিলে সেটি সুদে লাগনো হয়, কিংবা কোনো সুদি ব্যাংকে ফিক্সড করে রাখা হয়।

বিগত শীত মৌসুমটা গ্রামে কাটানোর ফলে এমন বেশ কিছু ঘটনা আমার কানে এসেছে। একদিন এরকম একটি আয়োজক কমিটি আসে আমার কাছে চাঁদার জন্যে। একথা সে কথার পর কালেকশন কমিটির প্রধান আমাকে জানায়, প্রধান বক্তা খাবারের যে মেন্যু দিয়েছে তাতে ১৬ প্রকারের মাছ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তার খুব টেনশন। এই ষোলো প্রকারের মাছের সংস্থান তিনি কিভাবে করবেন? গ্রামে টাকা হলেও সব সময় সবকিছু মেলানো যায় না তা ওই পেটুক মোল্লাকে কে বোঝাবে- এমন মন্তব্য করে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তিনি।

দেশে যেসব বক্তা মৌসুম ভর সারা দেশে ওয়াজ নসিহত করে বেড়ান তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি ফেরকা রয়েছে। এদের এক শ্রেণি কোরআনের সরাসরি তাফসীর করার চেষ্টা করেন। পুরো বয়ানটি কোরআন এবং তার রেফারেন্স হিসেবে হাদীসের উদৃতি দিয়ে থাকেন। আরেকটি শ্রেণি তাদের বয়ানে কোরআনের আয়াতের ব্যবহার করেন তবে তা অল্প এবং বিক্ষিপ্ত। দেড় দুই ঘণ্টায় বয়ানে দুই থেকে তিনটি আয়াত, এক দুটি হাদিসের রেফারেন্স থাকতে পারে। বাকিটা বিভিন্ন জনের জীবনী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আজগুবি কেচ্ছা-কাহিনী। পীর-মোরশেদের তরিকা বয়ানেই তাদের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়। 

আরেকটি শ্রেণি রয়েছে যাদের ওয়াজে নসিহতের চেয়ে বেশি থাকে বিনোদন। জিকিরে বিনোদন, বাচনভঙ্গিতেও বিনোদন পাওয়া যায়। এরা পীরপন্থীও নন আবার তাফসীরকারকও নন। বিভিন্ন টাইপের বাবার শান ও মান নিয়ে তাদের যত চেষ্টা-ফিকির। পুরো বয়ানে সহীহ কোরআন-সুন্নার কথার চেয়ে বেশি থাকে কথিত ওলী-আউলিয়াদের জীবনী। বাবা-মোরশেদদের নৈকট্য লাভের উপায় নিয়ে সুন্নতি বটিকা। তবে এই তিন প্রকারের বক্তাদেরই কম বেশি একে অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে দেখা যায়। 

সময় পাল্টাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাল্টাচ্ছে ওয়াজের মাঠের চেহারাও। এখন ওয়জের মাহফিলের প্যান্ডেল সাজাতে গিয়ে এতো বাড়াবাড়ি চোখে পড়ে যে কোনটা ওয়াজের মঞ্চ আর কোনটা যাত্রা গানের প্যান্ডেল সেটিও অনেক সময় বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। আর প্রধান গেটসহ বিভিন্ন স্থানে রকমারি লাইটিং দেখলে তাকে ওয়াজের মাঠ না ভেবে বিয়ে বাড়ির গেট কিংবা কনসার্টের স্পট ভাবলেও বোধ হয় ভুল হবে না। ওপরের চাকচিক্যকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ওয়াজ মাহফিল তার আসল উদ্দেশ্য থেকে সরে আসছে। বক্তার ভেতরের তাকওয়ার চাইতে এখন মুখের চাপাবাজির কদর বেশি।  তাইতো জিহাদীদের মতো বক্তাদের চড়া হাদিয়ায় নিয়ে এসে মানুষের অন্তর পরিষ্কারের ব্যর্থ আয়োজন করে আয়োজক কমিটি। তাইতো তাদের ওয়াজে সমাজে কোনো প্রভাব পড়ে না। পাড়ায় পাড়ায় ওয়াজ মেলানো এমন অসংখ্য যুব সমাজ ওয়জের পরদিনই আবার গা ভাসিয়ে দেয় গড্ডালিকা প্রবাহে। আমাদের পঁচা-ভঙ্গুর সমাজ তাই তেমনই রয়ে যায়। হয়তো থাকবে এমনই। 
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের