বৃহস্পতিবার,

২৮ মার্চ ২০২৪,

১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৃহস্পতিবার,

২৮ মার্চ ২০২৪,

১৪ চৈত্র ১৪৩০

Radio Today News

লহুর দরিয়া যেন স্নিগ্ধ সুগন্ধা

  মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১

আপডেট: ২৩:২০, ৩১ ডিসেম্বর ২০২১

Google News
লহুর দরিয়া যেন স্নিগ্ধ সুগন্ধা

লেখার শিরোনামটা কাব্যিক। কিন্তু বিষয়বস্তু মোটেও কাব্যিক নয় বরং প্যাথেটিক। অনেক সময় এই প্যাথেটিকতাও কাব্যের অংশ হতে পারে। কিন্তু অজকের লেখার বিষয়বস্তু মাত্রাগতভাবে এতোটাই প্যাথেটিক যে কেবল কবিতার মধ্যে একে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। তাই সামগ্রিক বিবেচনায় শিরোনমটা কাব্যিক রেখে এর ভেতরে গদ্যের প্রবেশ ঘটালাম।

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ইতোমধ্যে পৃথিবীব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। দেশতো বটেই সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসেও এই ধরণের অগ্নিকান্ডের ঘটনা বিরল হতে পারে। বিশালাকায় লঞ্চ। হাজারের বেশি যাত্রী নিয়ে রাজধানীর সদরঘাট থেকে দক্ষিণের জেলা বরগুনার পথে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে রাতের শেষ ভাগে এসে গাবখান চ্যানেলে সেটিতে আগুন লাগে। প্রকান্ড এ লঞ্চটিতে আগুন লাগার পরও প্রায় এক ঘণ্টা ধরে পানির ওপর চলছিলো সেটি। এই সময়ের মধ্যে যে দৃশ্যটি উঠে এসেছে সেটি ছিলো স্মরণকালের ভয়াবহ ঘটনা। বিষয়টা অনেকটা জাহান্নামের জলন্ত অগ্নিকূপের মতো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, কেউ কাউকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে না। সবাই নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। প্রচন্ড শীতের রাত, লঞ্চের আগুনের মধ্যে একটি অন্যরকম অন্ধকার, ধোঁয়া। বাইরের কিছুই দেখা যায় না। আন্দাজ করা যায় না কোথায় আছি, কিভাবে আছি। কেবল এইটুকু আন্দাজ করা যায় মৃত্যু খুবই নিকটে। যাতনাময় মৃত্যুর সাথে লড়ে হয়তো কিছুক্ষণ থাকা যাবে, কিন্তু শেষ রক্ষা হবে না। নিচে পানি ওপরে আগুন। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে শীতের রাতের হিমশীতল পানিকেই বেঁছে নিয়েছে। আবার কেউ সেই সুযোগটুকুও না পেয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মধ্যে নিজেকে সপে দিয়েছে। পুড়ে কঙ্কাল হয়েছে। অগ্নিকান্ডে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৫০। যাদের অধিকাংশই পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। দেহভষ্ণ মিলে গেছে অন্যান্যবস্তুর পোড়া ছাইয়ের সঙ্গে। 

অভিযান-১০ নামের ওই লঞ্চটি যখন জ্বলছিলো তখন দু’পাড়ের মানুষ তার পিছু পিছু দৌড়েছে। কেয়ামতের বিভীষিকা ছড়ানো সে রাতে সুগন্ধা পাড়ের বিস্তীর্ণ জনপদে চলে রোনাজারি, হাহুতাশ। মাঝ নদীতে একটি বিশালাকায় লঞ্চের গায়ে এমন আগুন কেউ দেখেনি কোনো কালে। কেউ শোনেনি নিচে অথৈ পানি কিন্তু সেই পানি আগুন নেভানোর কোনো কাজেই আসে না। অন্ধকার জনপদের মাঝে একটি লালটকটকে দানব। ভেসে চলেছে স্নিগ্ধ সুগন্ধার বুক চিরে। মানুষের চিৎকার, কান্না, আহাজারি, বাঁচাও, বাঁচাও বলে বেঁচে থাকার আর্তনাদ সবই কানে আসছে কিন্তু কিছুই যেন করার নেই কারো। এ যেন লহুর দরিয়া, এ যেন এমন নদী যার বুকে কোনো পানি নেই, সবটুকুই রক্ত। পুরোটাই মৃত্যু, বিষের পেয়ালা।

সেদিন ভোর রাতেই ঘুম ভাঙে। মুয়াজ্জিনের আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম। আমাকে শীতের ওম ওম গরম বিছানা থেকে উঠিয়ে দেয়। অযু করে নামাজ শেষ করি। তারপর সোস্যাল মিডিয়ায় চোখ বুলাতে গিয়ে হতবাক হয়ে যাই। প্রথমে বিষয়টি আন্দাজ করতে পারিনা সেভাবে। দু’তিন জনের পোস্ট দেখে সম্বিত ফিরে পাই। উতলা হয়ে উঠি। কারো কারো টাইমলাইনে আগুনের ছবি ভাসছে। প্রাথমিকভাবে যে দুয়েকটা ছবি সোস্যাল মিডিয়ায় আসে সেগুলো কেবলই নদীর আগুনের ছবি। খুব ভালো করে বোঝাও যায় না। সময় যত গড়াতে থাকে ততই সামনে হাজির হতে থাকে বিভীষিকাময় ছবিগুলো। যেগুলো দেখে কোনো হৃদয়বান মানুষই নীরব থাকতে পারেনি। হাহুতাশ করেছে। অস্থির হয়ে উঠেছে। আমিও অস্থির হয়ে যাই। সকাল থেকেই মূল ধারার গণমাধ্যমের প্রধান খবর হয়ে উঠে অভিযান-১০ ট্রাজেডি। একে একে সামনে চলে আসে একেকটি পরিবার, একেকজন মানুষের করুণ কাহিনী। 

বরগুনার বশির উদ্দিন। অসুস্থ শ্বশুরকে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসেছিলেন। কয়েকদিন থাকতে হবে তাই সঙ্গে এসেছিলো ছোট্ট মেয়েটিও। বাবার সঙ্গে ঢাকার আসার বায়না ধরেছিলো। সেই বায়না মেটাতে তাকে তার নানার সঙ্গেই ঢাকায় আনা হয়। পঞ্চম শ্রেণিতে পরীক্ষা দিয়ে এবার মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতো। কিন্তু তা আর হলো না। ঢাকায় কয়েকদিন বেড়িয়ে বাড়ি ফেরার সময় বন্ধুদের জন্য চকলেট কেনার কথা বলেছিলো। বাবা মেয়ের সে ইচ্ছা পূরণ করেছেন। দামি চকলেট কিনেছেন। জামা-জুতা আরো নানান কিছু। একমাত্র মেয়েকে বড় অফিসার বানানোর স্বপ্ন দেখতো। তাই মেয়ের কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেননি কখনো। শত কষ্টেও মেয়ের শখ-আহ্লাদ পূরণে সচেষ্ট ছিলো বশির। আগুন লাগার পর মেয়েকে নিয়ে লঞ্চ থেকে নদীতে লাফিয়ে পড়েছিলো বাবা। কিন্তু অন্ধকারে মেয়েকে ধরে রাখতে পারেনি। কোথায় হারিয়ে গেছে সে টের পায়নি। মেয়েকে যখন পাওয়া গেছে তখন সে নিথর, লাশ। লালটুকটুকে পরীর মতো মেয়েটাকে নিজ হাতে কবর দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে বশির। তার কান্নার কোনো সান্তনা হয় না। মেয়ে হারানো বাবার এই কষ্ট লাঘবের কোনো মেশিন এখনো তৈরি হয়নি। এ এক আজব মায়া, এই মায়া-মমতার কোনো পরিমাপ হয় না। কেবল যে হারায় সেই বোঝে? 

ইউটিউবে এমন অসংখ্য ভিডিও ভাসছে। বাবা-মা-ভাই-স্ত্রী-সন্তান হারানো এমন অসংখ্য গল্প। এমন অসংখ্য করুন উপখ্যান অশ্রুসিক্ত করছে দর্শকদের। বর্ননাগুলো কি সরল, অনুভূতিগুলো কি স্বাভাবিক কিন্তু কি নির্মম। ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার পর মাকে লঞ্চ থেকে নামাতে না পারার যে ব্যর্থতা কন্যার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে সেই বর্ননা সহ্য করা যায় না। সন্তান হয়ে চোখের সামনে মাকে পুড়তে দেখার কষ্ট কি কখনো লাঘব করা যায়? নিশ্চয়ই নয়। আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে এইসব স্বজন হারানোদের। 

অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত ব্রিটিশ কবি ফেলিসিয়া ডোরেথিয়া হেমান্সের লেখা ক্যাসাবিয়াঙ্কা কবিতাটি পড়েছিলাম অন্তত দুই দশক আগে। ক্লাসে পড়ানো সেই কবিতা আমার ভেতর এক অসম্ভব ঘোরলাগা জন্ম দিয়েছিলো। মাঝে মাঝেই কবিতাটির কথা মনে পড়তো। কবিতাটিতে ক্যাসাবিয়াঙ্কা চরিত্রটিকে যেমন চোখে ভাসতো তেমনি চোখে জ্বলজ্বল করতো অগ্নিদগ্ধ যুদ্ধ জাহাজটিও। আমি যেন চোখ বুজলে দেখতে পেতাম ডেকের ওপরে এডমিরাল বাবার নির্দেশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকপুত্র ক্যাসাবিয়াঙ্কা জ্বলছে। বাবার পরবর্তী নির্দেশ না আসায় সে সেখানেই পুড়ে মারা যায়। ছেলে ক্যাসাবিয়াঙ্কা ছিলো অত্যন্ত দায়িত্বপরায়ন, পিতৃভক্ততো বটেই। নিজ কর্তব্যের প্রতি ছিলো অবিচল। তাইতো যুদ্ধ জাহাজের ক্যাপ্টেন বাবার নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলো সে। বাবা স্থান ত্যাগের নির্দেশ দিলেই কেবল সে ওই স্থান ত্যাগ করতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার বাবা নিচ তলায় আগেই আগুনে পুড়ে মারা যায়। তাই বাবার নির্দেশও আর আসেনা আর ক্যাসায়িঙ্কাকারও স্থান ত্যাগ করা হয় না। সাহিত্যে তার মৃত্যুকে বিরোচিত হিসেবে যতটা না বিবেচিত করা হয়, তার চেয়ে বেশি এটাকে প্যাথেটিক বা হৃদয় বিদারক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সমালোচকরা হেমান্সের এ কবিতাকে সাহিত্যগুনে অনন্য হিসেবে উল্লেখ করলেও ক্যাসাবিয়াঙ্কার মৃত্যুকে তারা মনে করেন বিবেক বিবর্জিত হিসেবে। তাকে জ্ঞানশুন্য যুবক হিসেবেও কেউ কেউ আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেন। 

ব্রিটিশ এ কবির কবিতাটি হয়তো নিছকই কবিতা। কিন্তু ঝালকাঠির সুগন্ধা ট্রাজেডি কোনো কবির কল্পনাপ্রসূত কবিতার পটভূমি নয়। এটি এক কঠিন, ভয়ঙ্কর এবং মর্মান্তিক বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় লঞ্চ মালিক কিংবা তাদের নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আগুন লাগার পরও তারা প্রায় এক ঘণ্টা লঞ্চ চালিয়ে উদভ্রান্তের মতো সময় কাটিয়েছে। তীর না ভিড়িয়ে মাঝ নদীতে লঞ্চ থাকায় যারপরনাই হতাহতের সংখ্যা বেশি হয়েছে। হয়তো তাদের নিয়োজিত স্টাফরা যুদ্ধের আগেই রণেভঙ্গ দিয়ে মাঠ ছেড়ে দিয়েছিলো? হাজারো যাত্রীর নিরাপত্তার কথা না ভেবে হয়তো নিজেদের জীবন নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো তারা। তা না হলে এতো এতো মৃত লোকের মধ্যে এখনো কোনো লঞ্চ স্টাফের মৃত্যুর তথ্য কেন এলো না? এতো এতো পরিবার যখন তাদের নিখোঁজ স্বজনদের সুগন্ধা, বিষখালী, আর কচা নদী তীরে খুঁজে খুঁজে দিশেহারা তখন কোনো স্টাফের স্বজনদের কেন দেখা যাচ্ছে না তাদের সারিতে? এই দুর্ঘটনার কোনো অতীত উদাহরণ নেই। এমন মৃত্যুর কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। তাই এই লঞ্চের দায়িত্বরতদেরও কোনো অপরাধ নেই আমার চোখে।

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস/এসএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের