বৃহস্পতিবার,

০২ মে ২০২৪,

১৮ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহস্পতিবার,

০২ মে ২০২৪,

১৮ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

হাবিব মোস্তফা’র নির্বাচিত কবিতা

শিল্প-সাহিত্য ডেস্ক

প্রকাশিত: ০১:১৪, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপডেট: ০১:১৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

Google News
হাবিব মোস্তফা’র নির্বাচিত কবিতা

কবি হাবিব মোস্তফা

কালচার্ড সূফী ব্যক্তিত্ব কবি হাবিব মোস্তফা। একাধারে জনপ্রিয় সঙ্গীতজ্ঞ, সুরকার, গায়ক'ই নন তিনি, নজরুল গ‌বেষক ও লেখক তিনি। অন্তরালপ্রিয় এই উত্তরাধুনিক কবি নিজের ভেতর তৈরী করেছেন অনন্য এক আকাশ। গভীর অর্ন্তদৃষ্টিতে জীবনের ভেতর আরেক জীবনের বয়ান করেন তিনি। যেখানে থাকে প্রেম, পুরাণ, প্রকৃতি আর অলৌকিকতার অনুপম বয়ান। রেডিও টুডে অনলাইনের আজকের আয়োজনে থাকছে কবি হাবিব মোস্তফার একগুচ্ছ কবিতা।

১. অভিজিৎকে ভুলে গেছে মাধবীলতা

অভিজিৎকে ভুলে গেছে মাধবীলতা!
জীবনের যোগ বিয়োগের হিসেব মাটিচাপা দিয়ে-
অবরোধের দিনেও অফিসের ব্যালেন্স সিট নিয়ে ব্যস্ত থাকে সে।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে মেয়েটা-
অভিকে একনজর দেখার জন্য
জানলার পাশে-ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতো,
সেই মেয়েটাই এখন শোবার ঘরের জানালা বন্ধ রাখে সব সময়,
ছাদের সিঁড়িতেও পা দেয়না,
অভিকে ভেবে ভেবে আনমনা হয়ে-
বাথরুমে শাওয়ারের নিচে দীর্ঘ সময় বসে থাকেনা।

অভিকে ভুলেই গেছে মাধবীলতা!
মেলা থেকে অভির কিনে আনা আলতায়-
এখন আর পা রাঙায় না লতা,
ঘটা করে দেয়না পুতুলের বিয়ে,
শীতের ভোরে অভির জন্য নতুন ধানের খৈ নিয়ে-
স্কুলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেনা,
বাগানের সবচেয়ে বড় গোলাপটি-
খোঁপায় গুঁজে দেবার অপেক্ষায় থাকেনা! 

অভিকে ভুলেই গেছে মাধবীলতা!
তবু মনের ভুলে বুকের ওড়নাতে আজও অভির গন্ধ পায়,
ঘুমের দেশে অভির সাথেই সূর্যস্নানে যায়,
জ্বরের ঘোরে-ঝাপসা চোখে অভির বুকপশমে মাথা রেখে-
ঝিঁঝিঁ পোকার ছন্দময় ডাকে ব্যাকুল হয়।

অভিজিৎকে ভুলেই গেছে মাধবীলতা!
একদম ভুলে গেছে…


২. কারও কথা রাখিনি

কারও কথা রাখিনি আমি-
না বিধাতার, না প্রিয়তমার।

হাজার পাওয়ারের চশমা ছাড়া বাবা কিছুই চোখে দেখতেন না।
বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, ‘ইজি চেয়ারে শুয়ে শুয়ে টসটসে আঙ্গুর তুমি খেয়ো,
তাতেই চোখের জ্যোতি বেড়ে যাবে অনেক বেশী……
বাবার কবরটা এখন নিশ্চিহ্ন প্রায়,
ফ্রেমে বাঁধানো কাগজের ছবিটাও অস্পষ্ট,
ইজি চেয়ারটা পোকা মাকড়ের ক্ষুধা মিটিয়েছে সেই কবে….
কথা আমি রাখতে পারিনি।

শীতের রাতে আমার কাঁথার নিচে উত্তাপের আশায় 
উজ্জ্বল চোখের পোষা বিড়ালটাকে কথা দিয়েছিলাম:
‘মিনু, তোর চৌদ্দ গোষ্ঠিকে এভাবেই আগলে রাখব’।
….আমার অনুপস্থিতিতে খাবার চুরির অভিযোগে 
বৃদ্ধা মিনুকে গরম পানিতে ঝলসে দেয়া হয়েছিল।
মিনুর দুধের বাচ্চার মিউ মিউ কান্না এখনো আমাকে বিচলিত করে।
কথা আমি রাখতে পারিনি।

আমার প্রতি সুপর্ণার ভালোবাসাটা ছিল নির্মোহ
কোন দাবী দাওয়া ছিলনা একদম।
কথা দিয়েছিলাম, ‘তোর বন্ধুর পথের সহযাত্রী হবো,
নিশিকালো অমাবস্যার অন্ধকারে তোর চোখের তারায় পথ খুঁজে নেবো।’
….সুপর্ণা এখন অন্য কারো চোখে আলোর যোগান দেয়,
অন্য কারো হাত ধরে সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখে।
আর আমার মতো ভীরু কাপুরুষের মুখটা কল্পনা করে মুখভর্তি থুতু দেয়।
….কথা আমি রাখতে পারিনি।

 

৩. কবির জন্ম

কবিকে জন্মাতে হয় কালের প্রয়োজনে।
‘মহাকাল’ তাই ঋণী কবির মাটিরূপের কাছে।
কবির কলমে রক্তমাংসের সাধারণ নারী হয়ে ওঠে স্বর্গের অপ্সরা।
কবির পেন্সিলে রাক্ষস-রাবন পান দেবতার মর্যাদা।

‘কী ঘটিয়াছে জগৎ তাহা জানে না, কবি যাহা রচিয়াছেন-তাহাই ঘটিয়াছে’।
কবি গড়েন, কবি তাই ব্রহ্মা।
কবির হাতে কখনো ‘ইস্রাফিল’র শিঙ্গা, কবি মহা প্রলয়ের নটরাজ।
অনিয়ম-উচছৃঙ্খল সত্তার কাছে প্রথাগত ধর্ম বিধানে কী যায় আসে?
কবির ধর্ম আলাদা, কবির ভুবন সমগ্র লৌকিক সৃষ্টিকে ঘিরে আছে।
যেখানে রক্তপাত নেই, অসুর আরতি নেই, নেই প্রাপ্তির লোভ,
সেখানে কবি রাজমুকুট পরে সিংহাসনে আসীন। 
দন্ডধারী ফেরেস্তাদের ভয়ে কবিহৃদয় কিঞ্চিতও চিন্তিত নয়।
জান্নাতের শরাবান তাহুরা কবির তৃষ্ণা মেটাতে পারে না।

কবির গায়ের একটি পশম পোড়ানোর শক্তি জাহান্নামের আগুনের নেই।
কবির তৃপ্ত হাসিতে কোটি জান্নাত জাগ্রত,
জাহান্নামের চেয়ে তীব্র আগুন কবির অন্তরে সদা প্রজ্জ্বলিত। 
সে এক অন্য অনল।
তাই তো জাহান্নামের আগুনে বসেই পুষ্পের হাসিতে উদ্ভাসিত কবি।
‘কবিকে ভালোবেসে শতজনমের পাপ মোচন করা যায়’।
- এটা কবির আর্শীবাদ।
‘যে কবিতা শুনতে জানে না, সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে’।
- এটা কবির অভিশাপ।

‘ছায়ার ঢাকা মায়ার পাহাড়’র এক কন্যা -
ভীরু ভীরু হাতে ‘সোনালী কাবিনে’ স্বাক্ষর করে, 
‘বখতিয়ারের ঘোড়ায় চড়ে’ ছুটেছেন তেপান্তরের পথে…
যমুনার কূলে ‘কালের কলসে’ অমৃতের জল ভরেছেন। 
‘অদৃশ্যবাদীদের’ জন্য ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’ পুষেছেন। 
‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ তিনি শিখেছেন- 
‘নদীর ভিতরে আরেক নদী বয়ে চলার’ ছন্দ। 

‘সমুদ্র নিষাদে’ আত্মতহারা ‘গন্ধ বনিক’ রূপের বাজারে- 
‘সৌরভের কাছে পরাজিত’ হয়েও বার বার প্রেমে পড়েছেন।
‘বিচূর্ণ আয়নায়’ তৃপ্তির আত্মদর্শন করেছেন এক মহান কবি। 

 

৪. পদ্মাবতীর যৌবনপ্রাপ্ত নগ্ন পা

মধ্যরাতের ঝড়ে পদ্মাবতীর ঘুম ভেঙ্গে গেল।
এই প্রথম নিজেকে বড় একা মনে হল তার।
কম্পিত শরীরে আয়নার সামনে দাঁড়াল পদ্মাবতী।

নিভু নিভু আলোয় নাঙ্গা অবয়ব দেখে শিহরিত সদ্য যৌবনা।
আয়নার সাথে আত্মদর্শনের সলজ্জ প্রেম পদ্মাবতীর:
প্রকৃতির অনুপম-নিখুত নির্মান!
চোখ তার ফিরেনা, পলক তার পড়েনা।

বিদ্যুত চমকানিতে সজ্ঞা ফিরল তার।
দেবদূতের ইশারায় পোশাকের আশ্রয় নিল পদ্মাবতী।
‘অবুঝ বালিকা’ আজ পূর্ণ যুবতী!
সে বুঝতে পারল: 
‘তার খোলা শরীর উদ্যাম বাতাস আর দোলা দিতে পারবেনা’।
কারণ দেবতার ধ্যানভঙ্গের কারণ তার নাঙ্গা পুষ্পাঙ্গ।
কাজলও তাই সুযোগ বুঝে লেপ্টে গেলে তার ‘জোড়াভ্রুতে’।
হাতের কাকন রিনিঝিনি ছন্দে বেজেই চলছে।
পশমী কামিজ কামুক ভীমের মত পদ্মাবতীর কোমল শরীরে-
আঁকড়ে ধরে আছে।

পদ্মাবতীর ‘নগ্নপদের’ সাথে শিশিরের আশৈশব মিতালী।
বনের ঝরাপাতার মর্মর ধ্বনিতে-
পদ্মাবতীর ‘নগ্নপদ’ ছন্দ তোলে।
এই পা’কেও নাকি ঢাকতে হবে জুতোর আবরণে!
-এ কথা শুনেই শিশিরের কান্না আর থামছেনা।
পাখিও গান বন্ধ করে দিয়েছে।

পদ্মাবতীর নগ্নপদের স্পর্শ ছাড়া ঘাসের ঘুম ভাঙেনা,
ঘুমন্ত জমিনের প্রাণ ফিরেনা,
তার নাঙ্গা পায়ের পরশ না পেলে সৌরজগতের গ্রহরাজি -
আপন কক্ষপথে ঘুরার শক্তি হারায়,
নদী মোহনার পথ ভুলে যায়। 

কোন পথে যাবে পদ্মাবতী?
সভ্যতার অজুহাতে ঢেকে নিবে তার নগ্নপদ?
নাকি শিশিরের ভালোবাসায়, ঝরা পাতার প্রেমে,
শুধু নূপুরের আচ্ছাদনেই ঢাকবে তার যৌবন প্রাপ্ত পা?

 

৫. পরিণতি

চোখ দিয়ে যদি রক্তই না ঝরে
তবে সে কিসের অশ্রু?
তাকে বুঝাতে পারিনি আমার ভালবাসা
সে পেতে চায় আমার ভক্তি-অঞ্জলি।

লবনের কাছে কৃতজ্ঞতা-
প্রিয়ার দেয়া ক্ষতে-
তার উপস্থিতি-
আমাকে করেছে জাগ্রত মজনু!

প্রিয়ার নির্দেশ মত আটলান্টিকের উপর 
যোগ চিহ্ন দিয়ে দুজনের নাম লিখে যাচ্ছি
প্রতিনিয়ত স্রোত এসে মুছে দিয়ে যায়
তাতে কি? আমি অক্লান্ত-ধীর।

একদিন ড্রোনচোখে নিচে তাকিয়ে দেখবে সে
মরে পড়ে আছি তার বাসার গেটে।
শিকলবাঁধা রাতজাগা দারোয়ান কুকুরটা-
পা তুলে প্রস্রাব করতে এসে থমকে যাবে 
আর যত্নের বাগানে প্রিয়ার হাত থেকে
একটি ফুল ঝরে পড়বে আমার কপালে।

 

৬. সুনীলের বাবাকে মনে পড়ে 

অত্যাচারী প্রতিবেশিকে কৈশোরে 
মরিয়া হয়ে একবার বলেছিলাম বটে- 
দেখিস, এই মার একদিন দ্বিগুন হয়ে ফেরত যাবে! 
...তার প্রাপ্য তাকে ফেরত দেয়া হয়নি আজও 
এখনও ওরাই ছড়ি ঘোরায় মাথার ওপর।
 
সম্মানজনক একটা চাকুরি পেলেই 
ছেড়ে দেব এই ক্ষয়ে ক্ষয়ে বয়ে চলা একঘেয়ে কাজ
মনে মনে কত বার মহড়া দিয়েছি
এই রইল রেজিগনেশন লেটার;
...বড় কর্তাকে আজও দেখানো হয়নি সেই স্পর্ধিত চেহারা।

বলি বলি করেও আঙুল উঁচিয়ে বাড়িওয়ালাকে 
বলা হয়নি: টু লেট টাঙিয়ে দিন!
দিনের পর দিন তাই আলোবাতাসহীন এই অন্ধগলিতে বাস
...এক চিলতে বারান্দা, এক জানালা আকাশ ছাড়া 
একজন কবির চলে কী করে!

প্রতারক বান্ধবীকে বলেছিলাম
দেখে নিও, সময় জবাব দেবে
...সময় ফুরিয়ে এলো, সময় তবু জবাব দিল কই? 

সুনীলের বাবাকে মনে পড়ে, 
মিথ্যা আশ্বাসে, সন্তানকে তিনি বলেছিলেন-
“দেখিস একদিন আমরাও...”

রেডিওটুডে নিউজ/ইকে

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের