
তহবিল সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১ হাজার ২০০ শিক্ষককে হঠাৎ চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জাতিসংঘের শিশু তহবিল-ইউনিসেফ রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে ক্যাম্পে দীর্ঘদিন ধরে ‘লার্নিং স্কুল’ পরিচালনা করে আসছে। ইউনিসেফের তহবিলে দেশীয় বেশ কয়েকটি এনজিও প্রকল্পের মাধ্যমে স্কুলগুলো চালাচ্ছিল। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিদ্যায়তনে ৮ হাজার শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪ হাজার বাঙালি ও ৪ হাজার রোহিঙ্গা শিক্ষক। এদের মধ্যে বৃহস্পতিবার আকস্মিকভাবে ১ হাজার ২০০ বাঙালি শিক্ষককে চাকরিচ্যুতির বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়। বিনা নোটিশে চাকরি হারানোর প্রতিবাদে রোববার উখিয়া ও টেকনাফে বিক্ষোভ করেছেন চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা।
এদিকে ইউনিসেফের তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৪ লাখ শিশু ও কিশোর শিক্ষা ঝুঁকিতে পড়েছে। নতুন তহবিল সংগ্রহ করা না গেলে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘ইউনিসেফ তাদের তহবিল সংকটের কারণে ক্যাম্পের লার্নিং সেন্টার চালানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে। সব মিলিয়ে ক্যাম্পে ৪ লাখের মতো শিক্ষার্থী আছে। আর প্রাথমিকভাবে ১ হাজার ২০০ বাঙালি শিক্ষকের চাকরি চলে গেছে। অন্যদের বেতন পরিশোধ করার মতো অবস্থায় ইউনিসেফ নেই। বাকি শিক্ষকদের পর্যায়ক্রমে চাকরিচ্যুতির বিষয় জানানো হবে। বিষয়টি নিয়ে ইউনিসেফ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। তহবিল না পেলে এই সংকট থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় দেখছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লার্নিং স্কুলে মিয়ানমারের কারিকুলাম অনুসরণ করে পড়ানো হয়। সাধারণত বাঙালি শিক্ষকরা ইংরেজি পড়ান। কারও চাকরি চলে যাচ্ছে, এটা তার পরিবার এমনকি আমাদের জন্যও দুঃখজনক।’
এদিকে গতকাল শনিবার দিনভর উখিয়া শহীদ মিনার চত্বরে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদে ও পুনরায় চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। বিক্ষোভকারী শিক্ষকরা জানান, ‘বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য স্কুলগুলোতে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা উভয় সম্প্রদায়ের শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল। তবে হঠাৎ করে অর্থ সংকটের কারণ দেখিয়ে শুধু স্থানীয় ১ হাজার ২৫০ জন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। যেখানে রোহিঙ্গা শিক্ষকরা বহাল আছেন। আরও প্রায় ৩ হাজার শিক্ষককে ছাঁটাইয়ের প্রস্তুতি চলছে।’ এভাবে চললে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ পরিচালনাকারী কোনো এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চাকরি পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিক্ষকরা যদি কাজ করতে পারেন তাহলে আমরা কেন পারব না? শুধু আমাদেরই চাকরিচ্যুত করা হলো। এ বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নেব না।’ মাস পাঁচেক আগে বেতন বৈষম্য নিয়ে আন্দোলন করার কারণ তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে দাবি করেন তারা।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কামরুল হোসেন চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘ইউনিসেফের অর্থায়নে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন এনজিও ক্যাম্পে শিক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে আসছে। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে শিক্ষা প্রকল্পটি বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। এ বিষয়টি ইউনিসেফ চিঠিযোগে সরকারকে অবহিত করেছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্প চালানোর অর্থ তাদের রয়েছে বলে চিঠিতে বলা হয়েছিল। এর প্রতিবাদে দুইদিন ধরে শিক্ষকরা প্রতিবাদ করছেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘কোনো নোটিশ ছাড়া হঠাৎ চাকরি হারানোয় পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছি। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমার চুক্তি ছিল।’
রোববার ইউনিসেফ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় ইউনিসেফ যে কার্যক্রম চালায়, তার তহবিল সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে শরণার্থী শিবিরগুলোর ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর ওপর। এসব শিক্ষার্থী ইউনিসেফ সহায়তাপুষ্ট শিক্ষাকেন্দ্রে পড়াশোনা করে।
এদিকে গতকাল শনিবার ইউনিসেফ এক বিবৃতিতে বলছে, নতুন তহবিল গঠন এবং নতুন করে কার্যক্রম সাজানোর ‘নিরলস প্রচেষ্টা’ চালানোর পরও তহবিল সংকটের কারণে সংস্থাটিকে কিছু ‘কষ্টদায়ক’ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কিন্ডারগার্টেন থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকদের সহায়তা স্থগিত করার মতো বিষয়। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে ১ হাজার ১৭৯ জন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকের সঙ্গে ইউনিসেফের চুক্তি শেষ হবে। এই স্বেচ্ছাসেবকরা মূলত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সদস্য।
ইউনিসেফ বলছে, শিক্ষা কেন্দ্রগুলো চলতি জুন পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। এরপর এসব কেন্দ্র খোলার বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করবে নতুন তহবিল পাওয়ার ওপর।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম