মঙ্গলবার,

৩০ এপ্রিল ২০২৪,

১৭ বৈশাখ ১৪৩১

মঙ্গলবার,

৩০ এপ্রিল ২০২৪,

১৭ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

আন্তর্জাতিক পাচারকারীচক্রের কাছে বন্যপ্রাণীর অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ

শুভ্র শচীন, খুলনা 

প্রকাশিত: ০১:২৭, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

আপডেট: ০২:৪২, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

Google News
আন্তর্জাতিক পাচারকারীচক্রের কাছে বন্যপ্রাণীর অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ

দেশের বন্যপ্রাণীর অবৈধ ব্যবসা দিন দিন বড় হচ্ছে। গড়ে উঠেছে বন্যপ্রাণীর বিভিন্ন ক্রেতাশ্রেণী। আন্তর্জাতিক পাচারকারীচক্রের কাছে বন্যপ্রাণীর অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএ) বাংলাদেশ এবং ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের (সিসিএ) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বন্যপ্রাণীদের একটি বড়অংশের উৎস সুন্দরবন ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা।

বনবিভাগের একাধিক গবেষণায়ও বন্যপ্রাণী পাচারচক্রের প্রধান টার্গেট সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী আর বিদেশে পাচারের প্রধান গন্তব্য হিসেবে মিয়ানমার, ভারত ও চীনের কথা বলা হয়েছে। মূলত স্থল, নৌ ও আকাশপথে এসব বন্যপ্রাণী পাচার হয়। পাচারের সময় জীবিত ও মৃতবন্যপ্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বনবিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে। 

বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ভেতরে যেসব বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচার হয়, তার  বড়অংশই ধরা পড়ে না। এগুলো বিদেশে পাচার হয়। দেশের প্রায় ১৫টি বেসরকারি চিড়িয়াখানা, অবকাশকেন্দ্র ও বাগানবাড়িতে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী এনে রাখা হয়।

তাছাড়া বন্যপ্রাণীর অবৈধবাণিজ্য দমনে মূল চ্যালেঞ্জ অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনায় জটিলতা। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুযায়ী, বন্যপ্রাণী নিধন এবং ব্যবসার সর্বোচ্চ শাস্তি ১৫ লাখ টাকা জরিমানা ও ১২ বছরের কারাদণ্ড। 

র‌্যাব-৬ এর কোম্পানি কমান্ডার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, গত ১৮ জানুয়ারি র‌্যাব বনবিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চালিয়ে যশোরের মনিরামপুর, সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ এবং ১৫ জানুয়ারি খুলনার পাইকগাছার কপিলমনি থেকে ১০ প্রজাতির বিলুপ্ত প্রায় ২৬টি বন্যপ্রাণী উদ্ধার করে।

উদ্ধার হওয়া এসব বন্যপ্রাণীর মধ্যে ছিল একটি মেছো বিড়াল, একটি সজারু, দুইটি বানর, একটি গন্ধগোকুল, একটি অজগর, দুইটি গোখরা, দুইটি ধুসর বক, ছয়টি ডাহুক পাখি, একটি পানকৌড়ি এবং নয়টি সুদ্ধি কচ্ছপ উদ্ধার করে। বৃহস্পতিবার দুপুরে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে অবমুক্ত করা হয়।

তিনি বলেন, সুন্দরবনের এসব বন্যপ্রাণী অবৈধভাবে একটিচক্র চোরাইপথে পাচার করে এনে তা সংরক্ষণ করে। এর আগে গত বছরের ২৭ নভেম্বর উদ্ধার ১৬ প্রজাতির ৪৩টি বন্যপ্রাণী সুন্দরবনের করমজলে অবমুক্ত করা হয়।

দীর্ঘ দুই যুগেরও অধিক সময় সুন্দরবনে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন খুলনার দাকোপ উপজেলার ঢাংমারীর সীতেশ বাওয়ালী। সীতেশ বলেন, ‘গডফাদার মহাজন’-এর কাছ থেকে অগ্রিম ‘দাদন’ নিয়ে ছদ্মবেশে বনে ঢোকে একশ্রেণীর শিকারী।

এরা সুযোগ বুঝে বনে ঢুকে খাদ্যে বিষ অথবা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে অথবা ফাঁদ কিংবা বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা করে। তারপর স্থানীয় পদ্ধতিতে চামড়া, মাংসসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে গোপনে ঢাকা-চট্টগ্রামের চোরাচালানিদের ডেরায় পৌঁছে দেয়।

সীতেশ আরও জানান, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জসংলগ্ন গ্রামগুলোতে প্রায় দেড়শ’-এর অধিক সংঘবদ্ধ শিকারীদল রয়েছে। এদের অবস্থান বরগুনা জেলার পাথরঘাটার চরদুয়ানী, সুন্দরবন পূর্ববিভাগের বাগেরহাট জেলার শরণখোলা, রামপাল, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের খুলনা জেলার পাইকগাছা, দাকোপ, কয়রা এবং সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর ও কালিগঞ্জ উপজেলায়।

সুন্দরবনে কাজ করতে গিয়ে অনেক চোরাশিকারীদের মুখোমুখিও হয়েছেন সীতেশ। ওইসব শিকারীরা তাকে জানিয়েছেন, স্থানীয়ভাবে একটি বাঘের চামড়ার জন্য তারা দশ থেকে বারো লাখ টাকা পেলেও বিদেশে একটি বাঘের চামড়ার মূল্য এর কয়েকগুণ বেশি। 

বিশ্ববাঘ সম্মেলনের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, পৃথিবীর প্রায় ৪০টি দেশের কালোবাজারে বাঘের চামড়া কেনাবেচা হয়। বাঘের শুকনো মাংস ও হাড়চুর্ণ কাজে লাগছে বুড়ো কোটিপতিদের। তাদের বিশ্বাস, এসব সেবনে নাকি হারানো পৌরুষ ফিরে পাবে তারা!

১৯৬০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে অবৈধভাবে প্রায় ২০০টি বাঘ হত্যার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতসংখ্যা এরচেয়ে বহুগুণ বেশি বলে সীতেশের অভিমত। আর অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকার হয় তো হরহামেশা বলেন, সীতেশ।

তবে এসময় প্রায় শতাধিত বাঘের চামড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হলেও এর গডফাদাররা ধরা পড়েনি। বনবিভাগের কাছেও এ ব্যাপারে কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই। 

খুলনার সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনে বাঘ হত্যা কিছুটা কমলেও একেবারে তা বন্ধ হয়নি। বাঘের প্রধান খাবার হরিণ ও  অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকারও বন্ধ হয়নি।  
সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য বিষয়ে বন অধিদপ্তরের প্রধান বনসংরক্ষক আমীর হোসাইন চোধুরী বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী বিলুপ্ত প্রজাতির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্যপ্রাণীর ধারক ও বাহক হওয়া সত্ত্বেও এখানে বন্যপ্রাণীর অবৈধবাণিজ্য ভৌগোলিকভাবে বিস্তৃত। 

তিনি বলেন, বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচাররোধে শিকারী ও বনদস্যুদের গ্রেফতারের জন্য বনবিভাগ, র‌্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ড যৌথভাবে কাজ করছে। সুন্দরবনে ঢোকা এবং বের হওয়ার নদী-খালগুলোর মুখে তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।

বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য বিষয়ে বলেন, দুই হাজারের ওপর খাল রয়েছে আমাদের সুন্দরবনে। এসব খাল পাহারা দেওয়ার লোকবল অপ্রতুল। তারপরও এ অপ্রতুল লোকবল দিয়ে আমরা যতটুকু সম্ভব আইন প্রয়োগ করার চেষ্টা করছি।

রেডিওটুডে নিউজ/ইকে

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের