সোমবার,

২১ জুলাই ২০২৫,

৬ শ্রাবণ ১৪৩২

সোমবার,

২১ জুলাই ২০২৫,

৬ শ্রাবণ ১৪৩২

Radio Today News

উত্তরপত্র মূল্যায়নে গোপনীয়তা লঙ্ঘনে জড়িত অনেক শিক্ষক

রেডিওটুডে রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:১২, ২১ জুলাই ২০২৫

Google News
উত্তরপত্র মূল্যায়নে গোপনীয়তা লঙ্ঘনে জড়িত অনেক শিক্ষক

চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে গোপনীয়তা লঙ্ঘনে জড়িত অনেক শিক্ষক! খাতার ওএমআর অংশ বা ‘বৃত্ত’ পূরণের কাজ টিকটকার শিক্ষার্থীদের দিয়ে করিয়েছেন তারা। বিষয়টি সামনে এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া প্রায় ১০টি ভিডিও ও স্থিরচিত্রের মাধ্যমে, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

এ নিয়ে প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে আট পরীক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তদন্তে আরো বাড়তে পারে অভিযুক্তের সংখ্যা। এদিকে স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন ও স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের দিয়ে এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন এবং মোট নম্বরের যোগফল বের করে আসছেন একশ্রেণির শিক্ষক। এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে পরীক্ষার খাতা দেখতে পাওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সেই বিষয়ে গত শনিবার পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকদের আবার সতর্ক করে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড বলেছে, স্ত্রী-সন্তান-শিক্ষার্থী বা অন্য কাউকে দিয়ে খাতা মূল্যায়ন বা বৃত্ত ভরাট করানো দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ এ ধরনের কাজ করলে বা করার চেষ্টা করলে তার দুই বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। এর আগে গত ৫ মে প্রথম দফায় এ বিষয়ে পরীক্ষক ও প্রধান পরীক্ষকদের সতর্ক করা হয়।

এবার এসএসসি ও সমমানে ৬ লাখ ৬৬০ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। বিগত বছরের তুলনায় এটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক। সাধারণত প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ লাখ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়। তাহলে এ বছর এই বিপুলসংখ্যক ফেল কোথা থেকে এলো? অনেক শিক্ষার্থীর রেজাল্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কেউ কেউ ১১ বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছে। অথচ একটি বিষয়ে ফেল করেছে, যা স্পষ্টভাবে অস্বাভাবিক। শিক্ষার্থী টিকটকার দিয়ে এসএসসির খাতা দেখানো হয়েছে বলে এবার ফেল করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে—এই অভিযোগ অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের। এর প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বকশীবাজারে অবস্থিত ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সামনে বিক্ষোভ করে ফেল করা একদল শিক্ষার্থী। বিক্ষোভ শেষে শিক্ষার্থীরা আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবিরের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বলেন, এ বছর সাড়ে ৬ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছেন। টিকটকাররা পরীক্ষার খাতা দেখায় এ দুরবস্থা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তারা। একাধিক পরীক্ষার্থী বলেন, আমাদের খাতা যারা দেখে তারা টিকটকার। আমাদের খাতা দেখে তা নিয়ে রিলস বানিয়ে তারা টিকটকে আপলোড করে। টিকটকে ভাইরাল হওয়া খাতা দেখার ভিডিওগুলো মোবাইলে দেখিয়ে দেয় শিক্ষার্থীরা। এ সময় বিষয়টি তদন্ত করে দেখার আশ্বাস দেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান। এর আগে ১৪ ও ১৫ জুলাইও ফেল করা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ঢাকা বোর্ডের সামনে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। তবে বৃহস্পতিবারের বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এবার সোয়া ২ লাখ শিক্ষার্থী খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেছে।

ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে শোকজ করা চিঠিগুলোতে বলা হয়, ২০২৫ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র শিক্ষার্থীদের দিয়ে বৃত্ত ভরাট করানো হয়। এসব ভিডিও বা স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়। এ কার্যকলাপের ফলে শিক্ষা বোর্ডের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং পরীক্ষার্থীদের মনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। পরীক্ষার উত্তরপত্র প্রধান পরীক্ষক বা পরীক্ষক ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি, শিক্ষার্থী বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্যকে দিয়ে বৃত্ত ভরাট বা পূরণ করানো বা মূল্যায়ন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এছাড়া এ অপরাধের জন্য শোকজ করা পরীক্ষকদের বিরুদ্ধে কেনো বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তার জবাব পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বরাবর পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। অভিযুক্তরা হলেন—ঢাকার রোকেয়া আহসান কলেজের মুরছানা আক্তার, তার পরীক্ষিত বিষয় ছিল এইচএসসি ইংরেজি ২য় পত্র। গাজীপুরের ভাষাশহিদ আব্দুল জব্বার আনসার ভিডিপি স্কুল অ্যান্ড কলেজের মো. রাকিবুল হাসান, তার পরীক্ষিত বিষয় ছিল এইচএসসি বাংলা ২য় পত্র। ঢাকার হাজি ইউনুছ আলী কলেজের মো. জাকির হোসাইন, তার পরীক্ষিত বিষয় ছিল এইচএসসি বাংলা ২য় পত্র। নরসিংদী বারৈচা কলেজের মধুছন্দা লিপি, তার পরীক্ষিত বিষয় ছিল এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র। ঢাকার মোহাম্মদপুরের সেন্ট যোসেফস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের মহসীন আলামীন, তার পরীক্ষিত বিষয় ছিল এসএসসি উচ্চতর গণিত। ঢাকার যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মো. সাখাওয়াত হোসাইন আকন, তার পরীক্ষিত বিষয় ছিল এসএসসি ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা। ঢাকার মুন্সীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের আবু বকর সিদ্দিক, তার পরীক্ষিত বিষয় ছিল এসএসসি গণিত। রাজবাড়ীর রাজবাড়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সমীরময় মন্ডল, তার পরীক্ষিত বিষয় ছিল এসএসসি গণিত।

সাম্প্রতিক সময়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা নিয়ে নিয়মবহির্ভূত যে ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মজা, বিদ্রুপ ও হাস্যরসের উপস্থাপন পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলছে। টিকটক, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ঘাঁটলেই দেখা যাচ্ছে, খাতা কাটছেন শিক্ষার্থীরাই, কেউ আবার খাতা হাতে বসে খিচুড়ি, লুচি, পরোটা খাচ্ছেন। যেখানে এক পাশে রাখা খাতা, আরেক পাশে চাটনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা নিজেরাই খাতার ওএমআর অংশ (বৃত্ত) পূরণ করছেন। কোথাও কোথাও একাধিক শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে বসে খাতা পূরণ করতে দেখা গেছে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি শেয়ার করে এক শিক্ষার্থী ক্যাপশন দিয়েছেন, ‘বোর্ডের খাতা কাটছে টিকটকার’। আরেক জন লিখেছেন, ‘তোমাদের খাতা এখন আমাদের হাতে’। কেউ কেউ আবার ফল নিয়েও মজা করে লিখেছেন, ‘কে ভাই এইটা ৯২ পাইছে’। এসব পোস্ট এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যা নিয়ে বোর্ড পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে বিশ্বাসযোগ্যতা ও সার্বিক মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ অবস্থায় উদ্বেগ, হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন ২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষার খাতার গোপনীয়তা লঙ্ঘনের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর তারা প্রশ্ন তুলছেন কেন্দ্রীয় পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের যথাযথ পদ্ধতি ও বোর্ডের নজরদারি নিয়ে।

এসএসসির ফল রিভিউয়ে রেকর্ড সংখ্যক আবেদন, গণিতে সর্বোচ্চ :চলতি বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে অসন্তোষ জানিয়ে রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছে। গত ১৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হারে ফল চ্যালেঞ্জ করেছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে ৯২ হাজার ৮৬৩ জন শিক্ষার্থীসহ মোট ২ লাখ ২৩ হাজার ৬৬৪টি খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছে। তাদের কেউ এক বিষয়ে, কেউ দুই বা ততধিক বিষয়ে আবেদন করেছে। ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছিল ১১ জুলাই থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত। টেলিটক মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ের জন্য নির্ধারিত ১৫০ টাকা ফি দিয়ে আবেদন করে শিক্ষার্থীরা। গত বছর ঢাকা বোর্ডে এসএসসির ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছিল ৭১ হাজার ৩৪ জন। সেই হিসাবে এবার ২১ হাজার ৮২৯ জন শিক্ষার্থী বেশি আবেদন করেছে। খাতা চ্যালেঞ্জের সংখ্যাও গত বছরের চেয়ে এবার ৪০ হাজার ১২১টি বেড়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এ বছর গণিত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়েছে ৪২ হাজার ৯৩৬টি। এছাড়া ইংরেজি খাতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন জমা পড়েছে ১৯ হাজার ৬৮৮টি, পদার্থবিজ্ঞানে ১৬ হাজার ২৩৩টি, বাংলায় ১৩ হাজার ৫৫৮টি এবং বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রে ১৩ হাজার ৫৫৮টি আবেদন করা হয়েছে। সবচেয়ে কম আবেদন পড়েছে চারু ও কারুকলায়, মাত্র ছয়টি। তবে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন মানেই নতুন করে খাতা মূল্যায়ন নয়, বরং উত্তরপত্রে নম্বর গণনায় ভুল, প্রশ্ন বাদ পড়া, ওএমআর শিটে নম্বর না ওঠানো বা ভুল বৃত্ত ভরাট হয়েছে কি না—এসব যাচাই করা হয়। এসব ক্ষেত্রেই সংশোধন করে ফলাফল নতুন করে প্রকাশ করা হয়। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার সাংবাদিকদের বলেন, ফল প্রকাশের তারিখ থেকেই ৩০ দিনের মধ্যে পুনর্নিরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশের নিয়ম রয়েছে। সেই হিসাবে আগামী ৯ আগস্টের মধ্যেই ফলাফল প্রকাশ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যাদের ফল পরিবর্তন হবে, তাদের মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে জানানো হবে। সংশোধিত ফল বোর্ডের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হবে।

ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এস এম কামাল উদ্দিন হায়দারের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, পরীক্ষার উত্তরপত্র হলো একটি গোপনীয় দলিল এবং এটি প্রধান পরীক্ষক বা পরীক্ষকদের কাছে পবিত্র আমানত হিসেবে বিবেচিত। কোনোভাবেই প্রধান পরীক্ষক বা পরীক্ষক ব্যতীত অন্য কেউ যেমন—শিক্ষার্থী, শিক্ষক বা পরীক্ষকের পরিবারের সদস্যরা উত্তরপত্রে বৃত্ত ভরাট বা মূল্যায়ন করতে পারবেন না। এমনটা করলে সেটি হবে পরীক্ষা পরিচালনা সংক্রান্ত ১৯৮০ সালের আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের