
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে পুনর্বহালে একমত হলেও এর গঠন পদ্ধতি, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। এ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ চারটি দল লিখিতভাবে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের প্রস্তাবগুলো ও অন্যান্য দলের মতামতের ভিত্তিতে একটি সংশোধিত সমন্বিত প্রস্তাব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। দলগুলো নিজ নিজ দলীয় ফোরামে এ নিয়ে আলোচনা করে আগামীকাল মঙ্গলবার কমিশনকে মতামত জানাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গতকাল রবিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের ১৫তম দিনের সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন ও প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় ঐকমত্য না হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠক শেষে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, গতকাল আলোচনার প্রথমার্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে কমিশন। ঐ আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দলের মতামতের আলোকে কমিশন সভা করে দলসমূহের কাছে পুনরায় একটি সংশোধিত সমন্বিত প্রস্তাব প্রদান করেছে। প্রস্তাবটিতে বিস্তারিতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং এই প্রস্তাবের অধিকাংশ বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। এই খসড়া প্রস্তাবটির ওপর ভাষাগত ও খুঁটিনাটি দিক পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোর আগামীকালের মতামত প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গলবার এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করবে কমিশন।
সকালে ফরেন সার্ভিস একাডেমির সামনে তিন দফা দাবিতে মানববন্ধনকারী জুলাই অভ্যুত্থানে আহত-শহিদ পরিবারের সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, এই মানববন্ধন কর্মসূচির সঙ্গে আমরা আন্তরিক সংহতি প্রকাশ করছি। একটি জাতীয় সনদ তৈরির লক্ষ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেছে ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার মধ্য দিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং বাকি দিনগুলোর আলোচনায়ও আরো কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি জানান, এই প্রক্রিয়া চলমান থাকলে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব হবে।
সংসদের উচ্চ কক্ষ প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোনো ভিন্নমত নেই উল্লেখ করে কমিশনের সহসভাপতি বলেন, উচ্চ কক্ষ কীভাবে হবে তা নিয়ে দুটি ভিন্ন প্রস্তাব আছে। রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে কমিশনের কাছে দায়িত্ব অর্পণ করার মতামত দিয়েছে। কমিশন ইতিমধ্যে উচ্চকক্ষ বিষয়ে বৈঠক করেছে। উচ্চকক্ষ কীভাবে হবে তা নিয়ে কমিশন আরেকটু সময় নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে গতকালের আলোচনায়ও বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং এবি পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নেন। আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে আলোচনায় কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে দলগুলো যা বলল
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে আদালতের রায়ের ওপর বিএনপির আস্থা রাখছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলেও বিষয়টি এখনো আপিল বিভাগের রিভিউ পর্যায়ে বিচারাধীন রয়েছে। আমরা আশা করি, আদালতের রায়ের মাধ্যমেই এই ব্যবস্থা আবার চালু হবে। আদালতের রায়ে যদি ব্যবস্থা পুনর্বহাল না-ও হয়, সেক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ চাইলে আইন করে নতুনভাবে এই পদ্ধতি চালু করতে পারে। তিনি বলেন, বিচার বিভাগকে বিতর্কের বাইরে রাখতে হবে—এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে। সেখান থেকেই ঐকমত্য কমিশন একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে, যা নিয়ে দলীয়ভাবে আলোচনা করে মঙ্গলবার মতামত জানাতে বলা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনপ্রণালি নিয়ে দলগুলোর প্রস্তাবের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বিএনপি ও অন্য দলগুলো কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। কমিশন সেগুলো বিশ্লেষণ করে একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে। সেই খসড়ায় যদি কারো কোনো সংশোধনী বা পর্যবেক্ষণ থাকে, তারা তা জমা দিতে পারবে। রাষ্ট্রপতিকে প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে রাখার বিষয়ে বিএনপির প্রস্তাব এখন আর নেই বলেও তিনি জানান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব এসেছে বলে জানান সালাহউদ্দিন। এই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধির পাশাপাশি আরো দুজন সদস্য থাকতে পারেন বলে মত দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কমিটি বিভিন্ন দল বা জনগণের কাছ থেকে প্রস্তাবিত নাম আহ্বান করতে পারবে। এরপর সেগুলোর মধ্যে শর্ট লিস্ট হবে, প্রয়োজনে র্যাংকড চয়েস ভোটিংয়ের মাধ্যমেও নির্বাচন হতে পারে।
সালাহউদ্দিন বলেন, এভাবে একজন নিরপেক্ষ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাগরিককে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া তৈরি করা হচ্ছে। তিনি জানান, ৯০ দিনের জন্য নির্বাচনি দায়িত্ব পালনের বিধান আগের মতোই থাকবে। জরুরি পরিস্থিতিতে আরো ৩০ দিন সময় বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হলে প্রধান উপদেষ্টার ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর মতোই হবে, তবে সীমিত পরিসরে রুটিন দায়িত্বে সীমাবদ্ধ থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক প্রথা বিবেচনায় নিয়ে সবাই বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। আমরা একটি যৌক্তিক অবস্থানে আসতে পারব বলেই আশাবাদী।
একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা থাকার প্রশ্নে দলগুলোর ভিন্নমত
তত্ত্বাবধায়ক ছাড়াও গতকাল আরেকটি আলোচ্য ছিল একই ব্যক্তির একাধিক পদে থাকতে পারা না পারার বিষয়ে। এনিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা থাকার প্রশ্নে দলগুলো একমত হতে পারেনি। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এনসিপিসহ কয়েকটি দল একই ব্যক্তির একাধিক পদে থাকার বিষয়ে আপত্তি জানায়। দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানালেও প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা একজন হতে পারার পক্ষে মত দেয় জামায়াতে ইসলামী।
তবে, একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান—এই তিন গুরুত্বপূর্ণ পদে একসঙ্গে থাকার পক্ষে বিএনপি। অবশ্য, ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব হলো—একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে কেবল একটি পদে থাকতে পারবেন। কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত এনসিপিসহ কয়েকটি দল।
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার দায়িত্ব একসঙ্গে পালন নিয়ে খুব একটা মতভেদ নেই। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধানও হবেন কি-না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আমাদের দল লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে এবং আগের আলোচনায়ও একই যুক্তি উপস্থাপন করেছে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও দলের প্রধান ব্যক্তিই প্রধানমন্ত্রী হন। তবে, এটা নির্বাচন নয়, সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। সে ব্যক্তি যদি কোনো দলের প্রধান হন, তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় না।
বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় প্রধানের জন্য অপশন খোলা থাকা উচিত। কারণ, এটা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। পার্লামেন্টারি পার্টি যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। আবার তারা চাইলে অন্য কাউকেও মনোনয়ন দিতে পারে। কিন্তু সেই সুযোগটা রাখা জরুরি। শুধু দলীয় প্রধান হওয়ার কারণে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এমন বিধান গণতন্ত্রবিরোধী হবে। এটা সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার পরিপন্থি।
একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্য করে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-আহ্বায়ক আরিফুর ইসলাম আদীব বলেন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা হওয়ায় দেশে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। আমরা এই প্রথার অবসান চাই।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলের প্রধান—এই তিন গুরুত্বপূর্ণ পদে একই ব্যক্তি বহাল থাকলে রাজনৈতিক ভারসাম্য থাকে না। এতে সংসদ সদস্যরা মুখ খুলতে পারেন না, দলীয় নেতাকর্মীরাও আতঙ্কে থাকেন। আমরা মনে করি, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে পারেন, তবে একই সঙ্গে দলের প্রধান থাকা যাবে না। এতে রাজনৈতিক কাঠামোতে ভারসাম্য ফিরে আসবে, নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ তৈরি হবে।
সকালে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, চলতি মাসের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে চায়। এটা আপনারাও (রাজনৈতিক দল) নিঃসন্দেহে চান। তাই আমাদের পক্ষে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমরা অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছি। কিছু কিছু বিষয় আছে আলোচনার মধ্য দিয়ে নিষ্পত্তি করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে একটি সনদের জায়গায় যাওয়া। যেটা আপনাদের ইচ্ছা, আমাদের ইচ্ছা, সবার প্রচেষ্টা। দেশের সবাই সেটা প্রত্যাশা করছেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে আলোচনা বর্তমানে চলছে তার জন্য গত ১৪ বছর ধরেই লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এই লড়াইয়ে আমরা সবাই যুক্ত ছিলাম। এ আলোচনায় এসে আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে একমত হয়েছি। দ্রুতই এর রূপরেখা ও কাঠামো নিয়ে একমতের জায়গায় আসার আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, কমিশন এটা শুধু আশা করে না, বিশ্বাস ও করে
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম