
শরণার্থী হয়ে গেলে মানুষের চারপাশের জগৎ সংকুচিত হয়ে আসে। কিন্তু তাঁদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাবনা কখনোই সংকীর্ণ হয় না।
বিশ্বজুড়ে শরণার্থীরা প্রায়শই বেঁচে থাকার জন্য অসম্ভব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। কেউ কেউ ছেড়ে যান নিজের ভিটেমাটি, জীবিকা, কৃষিজমি, দোকান, চাকরি এমনকি প্রিয় পরিবার ছেঁড়ে অজানা ভবিষ্যতের দিকে পাড়ি দেন। নতুন পরিবেশে, অপরিচিত মানুষের মাঝে, কঠিন বাস্তবতায়। এটাই আজকের বাস্তবতায় এসে দাড়িয়েছে বিশ্বের ১২.৩ কোটি বাস্তুচ্যুত মানুষ।
বাংলাদেশে বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে, যার মধ্যে অন্তত ১ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৬ জন ২০২৪ সাল থেকে নতুনভাবে আগত। এছাড়া আরও হাজারো মানুষ এখনো নিবন্ধন ও সহায়তার অপেক্ষায়। এই পরিবারগুলো চরম দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা ও নিপীড়নের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে।
মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে বাঁচতে আন্তর্জাতিক সীমানা পেরিয়ে তারা এসেছে নিরাপত্তার আশায়। কেউ গ্রাম ছেড়েছেন, কেউবা শহর। আর এখন তাঁদের আশ্রয় মাত্র ১৫০ বর্গফুটের একটি ‘ঘর’।
শরণার্থী হয়ে গেলে মানুষের চারপাশের জগৎ সংকুচিত হয়ে আসে। কিন্তু তাঁদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, সম্ভাবনা কখনোই সংকীর্ণ হয় না।
এদিকে, স্থানচ্যুতি অব্যাহত থাকায়, মানবিক চাহিদা বাড়ছে এবং সেই তুলনায় সাহায্য কমে আসছে। জরুরি সেবাগুলো চালু রাখাই যেন এখন হুমকির মুখে।
ডব্লিউএইচও বলছে, ২০২৫ সালের যৌথ মানবিক সহায়তা পরিকল্পনায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা ও স্থানীয় আশ্রয়দাতা জনগণের জন্য প্রয়োজন ৯৩৪.৫ মিলিয়ন, অথচ বর্তমানে তার মাত্র ২১.৭% অর্থই পাওয়া গেছে। বৈশ্বিক সাহায্য কমে যাওয়ায় (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল স্থগিত) ও অন্যান্য দাতাদের অনুদান কমে যাওয়ার ফলে চিকিৎসা সেবা বন্ধ, ক্লিনিকসমূহ বন্ধ এবং সুরক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও আশ্রয় সহ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে কাটছাঁট করতে বাধ্য করা হয়েছে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে শিশু, নারী ও প্রতিবন্ধীদের ওপর।
বর্তমানে প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর শিক্ষাজীবন হুমকির মুখে। তহবিল সংকট অব্যাহত থাকলে, বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে শিশুদের মৌলিক শিক্ষার সুযোগ হারিয়ে যেতে পারে। খাদ্য অনুদানও বড় ধরনের কাটছাঁটের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে পরিবারগুলোকে স্বাস্থ্যসেবা, খাবার ও নিরাপত্তার মধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হতে হচ্ছে।
এই ধরনের নিঃস্ব অবস্থায় অনেক রোহিঙ্গা সমুদ্রপথে বিপজ্জনক যাত্রা শুরু করছে। গত ২০২৩ সালেই ৫৬৯ জন রোহিঙ্গা সমুদ্রে মৃত্যুবরণ বা নিখোঁজ হয়। এ মৃত্যু প্রায় এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালের শেষ থেকে ২০২৫ সালের শুরুর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরেই প্রায় ২০০টি মানব পাচারের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।
পুষ্টিহীনতা এখন একটি মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিশুদের মধ্যে গ্লোবাল অ্যাকিউট মালনিউট্রিশন (জিএএম) হার ১৫ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি পরিস্থিতির মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।
তীব্র অপুষ্টির (এসএএম) হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ফলে হাজারো শিশুকে তাৎক্ষণিক অপুষ্টির ঝুঁকিতে ফেলছে। আগের বছরের তুলনায় এই হারগুলো বেড়েছে। তবে সহায়তার ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো এই সংকটকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। মায়েরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেলে তাদের শিশুরা কোথায় যাবে? চিকিৎসাকর্মীর অভাব এবং স্বেচ্ছাসেবী রোহিঙ্গাদের হারিয়ে যাওয়ার কারণে প্রাথমিক চিকিৎসাও দুর্লভ হয়ে উঠছে। এই গল্পগুলো প্রতিটি শিবির, খাদ্য লাইনে, এবং সেবাকেন্দ্রে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মাঝেও বৈশ্বিক মনোযোগ কমে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট যেন চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। আশ্রয়দাতা বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীও চাপের মুখে—সম্পদ কমে যাচ্ছে, জীবিকার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে। যথাযথ অর্থায়ন না হলে, সেবা আরও কমে যাবে। এছাড়া সংকট দীর্ঘায়িত ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে উত্তেজনাও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ঐক্য ও সমন্বিত উদ্যোগ এখন জরুরি। এছাড়া রোহিঙ্গাদের অধিকার, মর্যাদা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য।
এই সংকটকে একটি ‘ভুলে যাওয়া বিপর্যয়’ হতে দেওয়া যাবে না। রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের পাশে থাকতে হবে। এছাড়া মানবতা, মর্যাদা ও আশার পক্ষে অবস্থান নেওয়া খুবই জরুরি।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম