
নিঃসন্দেহে মিউনিখে নতুন এক ইতিহাস তৈরি হলো। যে শহর একসময় অলিম্পিক মার্শেইয়ের স্বপ্নপূরণের সাক্ষী হয়েছিল, ৩২ বছর পর ঠিক সেখানেই আরেকটি ফরাসি ক্লাব লিখে দিল নতুন এক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ মহাকাব্য।
শনিবার (৩১ মে) দিবাগত এই রাতে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন (পিএসজি) শুধু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেনি, তারা ইউরোপিয়ান ফুটবলের মঞ্চে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। ইন্টার মিলানকে ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করে, একেবারে একপেশে ম্যাচে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করল তারা। ইউরোপে এখন নতুন রাজা, নতুন রাজত্ব শুরু করলো পিএসজি।
যেখানে একসময় মেসি-নেইমার-এমবাপে ত্রয়ীও ব্যর্থ হয়েছিলেন, সেখানে ডেম্বেলে, হাকিমি, ভিতিনহা, কাভারাৎসখেলিয়া আর দিজেরে দুয়েরা মিলে লিখে ফেললেন সেই অসমাপ্ত অধ্যায়ের পরিণতি।
এ যেন মিউনিখের অলিখিত নিয়ম মেনে চলা এক নতুন ইতিহাস, যেখানে নতুন চ্যাম্পিয়নরাই পায় রাজত্বের মুকুট। পিএসজির জন্য এ শুধু একটি শিরোপা নয়, বরং ট্রেবল জয়ের মহোৎসবের সিংহদ্বার।
পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই দলকে বল দখলে রেখে আক্রমণ সাজানোর দর্শনে পরিচালিত করেছেন কোচ লুইস এনরিকে। নিখুঁতভাবে ফাইনালেও তার সেই কৌশলের প্রতিফলন দেখা গেল । শুরু থেকেই পিএসজির ধারাবাহিক আক্রমণের মুখে পড়েই দিশেহারা হয়ে পড়ে ইন্টার মিলান।
ম্যাচের প্রথম ১৫ মিনিটেই পিএসজি বল দখলে রেখেছিল ৬৩ শতাংশ সময়েরও বেশি। আক্রমণের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত ছন্দে ছিল তারা। প্রথম ১০ মিনিটেই অন্তত দুইবার দূরপাল্লার শট নিয়ে ইন্টারের রক্ষণকে সতর্কবার্তা দিয়ে দেয় লা প্যারিসিয়ানরা। আর সেই চাপই শেষ পর্যন্ত ফল দেয় দ্রুতই।
১২ মিনিটে ভিতিনহার ডিফেন্সচেরা পাস ডি-বক্সে খুঁজে নেয় দুয়েকে। দারুণ দক্ষতায় বল রিসিভ করেন এই উইঙ্গার। নিজে ছিলেন আনমার্কড। এরপরেই নিঃস্বার্থ পাস দিলেন আশরাফ হাকিমিকে। আলতো টাচে নিজের সাবেক ক্লাবের বিপক্ষে গোল করেন হাকিমি। আরও একবার নিজেদের ডিফেন্সে ম্যান মার্কিংয়ে ভুলের কারণে গোল হজম করল ইতালিয়ান ক্লাবটি।
এর মিনিট আটেক পর ফের গোল পিএসজির। আগের গোলের যোগানদাতা দুয়ে এবার নিজেই করলেন গোল। ওসমান ডেম্বেলের সঙ্গে বোঝাপড়ায় দারুণ এক আক্রমণ সাজায় দল। এবারেও নিজেদের বাজে মার্কিংয়ের খেসারত দিয়েছে ইন্টার। ফাঁকায় থাকা দুয়ে খানিক সময় নিয়েই শট নিয়েছিলেন। বল ডিমার্কোর পায়ে লেগে কাছের পোস্টে গোল। দলের স্কোরলাইন করেন ২-০।
দুই গোলে পিছিয়ে পড়ার পর সেটপিসে ভাল সুযোগ এসেছিল ইন্টারের জন্য। তবে এর কোনোটিই কাজে লাগেনি। দুইদফায় বল তারা রাখতে পারেনি পোস্টে। এমনকি পিএসজিও দারুণ আক্রমণ শানিয়ে ব্যবধান বাড়ানোর চেষ্টা চালায়। যদিও কাঙ্ক্ষিত গোল আর আসেনি। ২-০ গোলের লিড নিয়েই পিএসজি ফেরে টানেলে।
বিরতির পর দুই দলেরই খেলা শুরু হয়েছিল কিছুটা ধীরগতিতে। ইন্টার মিলান সমতা ফেরানোর লক্ষ্য নিয়ে বারবারই আক্রমণে উঠতে চেয়েছে। তবে প্যারিসিয়ানদের শক্ত রক্ষণের সামনে তারা ছিল বিবর্ণ। বিপরীতে পিএসজি উপহার দিয়েছে একের পর এক কার্যকরী কাউন্টার অ্যাটাক। যার প্রথম সুফল মেলে ৬৩ মিনিটে।
ওসমান ডেম্বেলের ব্যাকহিল থেকে বল পেয়ে চমৎকার এক মাপা পাস দিয়েছিলেন ভিতিনহা। ফার্স্ট টাচ শটেই আসে গোল। ইয়ান সোমার পারেননি কাছের পোস্টের শট আটকাতে। ৩-০ গোলের লিড পিএসজির। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক ঠিক ১০ মিনিট পর আরেকটা গোল পেয়ে যায় পিএসজি। এবারও অ্যাসিস্টে ডেম্বেলে। কাউন্টার অ্যাটাকে সহজ ফিনিশ কাভিচা কাভারাৎসখেলিয়ার।
৮১ মিনিটে ব্র্যাডলি বারকোলা যদি অবিশ্বাস্য সেই সুযোগটি মিস না করতেন, তাহলে ব্যবধান আরও বাড়তে পারত পিএসজির পক্ষে। তবে সেটি নিয়ে আফসোসের সুযোগ নেই। কারণ, মাত্র পাঁচ মিনিট পরই—৮৬ মিনিটে—বারকোলার পাস থেকেই সেনি মায়ুলু গোল করে গড়ে দেন ইতিহাস।
৫-০ গোলের বিশাল এই জয় শুধু ফাইনাল জয়েরই বার্তা দেয়নি, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের ইতিহাসেও এটি হয়ে রইল সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়। ইউরোপিয়ান ফুটবলে এখন নতুন রাজা প্যারিস সেইন্ট জার্মেইন।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম