
২৭ জুন, ‘কাঁটা লাগা’ খ্যাত অভিনেত্রী শেফালি জারিওয়ালার আকষ্মিক মৃত্যুর খবর হতবাক করে দেয় সবাইকে। হৃদরোগে ৪২ বছরের এই অভিনেত্রীর মৃত্যুর পর শুরু হয় নানা জল্পনা। এরই মধ্যে তার মৃত্যু নিয়ে একেবারে লুকানো একটি কারণ সামনে আনলেন ভারতীয় চিকিৎসকরা। তাদের ইঙ্গিত, অ্যান্টি এজিং বা বার্ধক্য নিরোধী অনিয়ন্ত্রিত চিকিৎসার দিকে। চিকিৎসকরা মনে করেন, এতে কখনও কখনও মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
অ্যান্টি এজিং চিকিৎসা সঙ্গে উপোস
মৃগীরোগের ইতিহাস থাকা শেফালি খালি পেটে ‘গ্লুটাথিয়ন’ এবং ‘ভিটামিন সি’ যুক্ত একটি অ্যান্টি এজিং কসমেটিক ইনজেকশন নিয়ে থাকতে পারেন। যার ফলে রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা হৃদরোগের কারণ হতে পারে। যদিও মৃত্যুর সঠিক কারণ তদন্তাধীন এবং ময়নাতদন্তের রিপোর্টের অপেক্ষায়। তবে ভারতীয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাকরা অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টি এজিং থেরাপি ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করছেন।
পুনের রুবি হল ক্লিনিকের কনসালট্যান্ট কার্ডিওলজিস্ট ডা. অনিশ জৈন বলেন, যদিও ত্বকের চিকিৎসায় ‘গ্লুটাথিয়ন’ এবং ‘ভিটামিন সি’ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, তবুও পানিশূন্য বা উপোস অবস্থায় এই জাতীয় যৌগগুলো ব্যবহার করলে হৃদযন্ত্রের ওপর অপ্রয়োজনীয় চাপ পড়তে পারে। বিরল ক্ষেত্রে, এর ফলে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে কমে যেতে পারে, যা সম্ভবত কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) অনুমোদিত 'অ্যান্টি এজিং' ওষুধের কোনো স্বীকৃত বিভাগ নেই। এই চিকিৎসাগুলোর বেশিরভাগই অফ-লেবেল, পরীক্ষামূলক অথবা প্রসাধনী প্রকৃতির। এতে সঠিক দীর্ঘমেয়াদী কার্ডিওভাসকুলার সুরক্ষা তথ্যের অভাব রয়েছে।
একটি তাৎক্ষণিক গবেষণায় চিকিৎসকরা দেখেছেন, খাদ্যতালিকায় পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত গ্লুটাথিয়ন পাউডার ব্যবহারের বিরুদ্ধে এফডিএ স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছে। ইনজেকশনযোগ্য ওষুধের মিশ্রণের জন্য ব্যবহৃত এই গ্লুটাথিয়নে এন্ডোটক্সিন দূষণের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিকূল ঘটনার রিপোর্ট পাওয়া গেছে।
তারা জানান, ত্বক ফর্সা করার জন্য ইনজেকশনযোগ্য গ্লুটাথিয়নও এফডিএ অনুমোদিত নয়। এমনকি গ্লুটাথিয়নের নিরাপত্তা বা কার্যকারিতা সমর্থন করার জন্য কোনো প্রকাশিত ক্লিনিকাল ট্রায়াল বা সরকারি নির্দেশিকা নেই। বরং এফডিএ লিভার, কিডনি এবং স্নায়ুতন্ত্রের ওপর বিষাক্ত প্রভাব এবং স্টিভেনস-জনসন সিনড্রোমের মতো সম্ভাব্য গুরুতর প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকিগুলো রয়েছে।
ত্বক ফর্সা করার জন্য ইনজেকশনযোগ্য ‘ভিটামিন সি’ পণ্যগুলোও এফডিএ অনুমোদিত নয়। ২০১৯ সালে এফডিএ সমস্ত কোম্পানিকে ‘অ্যাসকরবিক অ্যাসিড’ বা ‘ভিটামিন সি’ ইনজেকশনের অননুমোদিত সংস্করণ বিতরণ বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেছিল।
ভারতের সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন বা সিডিএসসিও ‘গ্লুটাথিয়ন’ এবং ‘ভিটামিন সি’ ইনজেকশন অনুমোদন করেছে। তবে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট চিকিৎসার জন্য, প্রসাধনী বা ত্বক সাদা করার জন্য নয়।
অ্যান্টি এজিং চিকিৎসার সমস্যা
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ, ‘গ্লুটাথিয়ন’ এবং ‘ভিটামিন সি’ সরাসরি হৃদপিণ্ডের ওপর প্রভাব ফেলে না। তবে খালি পেটে শিরাপথে বা অন্য ওষুধের সঙ্গে গ্রহণ করলে তার প্রভাব বিপজ্জনক ক্যাসকেড তৈরি করতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে হাইপোটেনশন এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। এটি যে কেবল ‘গ্লুটাথিয়ন’ বা ‘ভিটামিন সি’ নয়, এটি বিভিন্ন ধরণের অ্যান্টি এজিং ওষুধের সঙ্গে সম্পর্কিত।
লীলাবতী হাসপাতালের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট ডা. শ্রীনিবাস কুদভা বলেন, দীর্ঘায়ু এবং বয়স ধরে রাখার প্রতি বিশ্বব্যাপী আগ্রহের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অ্যান্টি এজিং ওষুধগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
তিনি বলেন, এই থেরাপিগুলো হরমোন মড্যুলেশন (যেমন, টেস্টোস্টেরন, গ্রোথ হরমোন) থেকে শুরু করে কোষীয় বিপাক এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ফাংশন (যেমন, NAD+ বুস্টার, mTOR ইনহিবিটর) পর্যন্ত বিভিন্ন জৈবিক প্রক্রিয়াকে লক্ষ্য করে। যদিও অনেকগুলো কোষীয় স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধি এবং জৈবিক বার্ধক্য ধীর করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, তবে হৃদরোগের স্বাস্থ্যের ওপর তাদের প্রভাব সমানভাবে ইতিবাচক নয়।
ডা. শ্রীনিবাসের ভাষ্য, এই হরমোনাল এজেন্টগুলো হৃদরোগের গতিশীলতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে টেস্টোস্টেরন বা গ্রোথ হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন, রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে। একই সঙ্গে লিপিড বিপাক পরিবর্তন হতে পারে। যার সবকটিই অ্যারিথমিয়া, ধমনী শক্ত হয়ে যাওয়া বা থ্রম্বোটিক ইভেন্টের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এমনকি NAD+ প্রিকার্সারগুলির মতো নতুন যৌগগুলো বিপাকীয় কার্যকলাপকে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে; যোগ করে ডা. শ্রীনিবাস।
নারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি
বিশ্বব্যাপী এবং ভারতে হৃদরোগ (CVD) এখন নারীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ। এটি এখন স্তন ক্যান্সারকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আকাশ হেলথকেয়ারের কার্ডিওলজির পরিচালক ডা. আশীষ আগরওয়াল বলেন, মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রায়শই সিভিডি উপেক্ষা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে হার্ট অ্যাটাক এবং কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট স্তন ক্যান্সারের তুলনায় ১০ গুণ বেশি নারীর মৃত্যু ঘটায়। ১৫-৪৯ বছর বয়সী প্রতি পাঁচ জন ভারতীয় নারীর মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করান না। কিন্তু প্রাথমিক স্ক্রিনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যাথ ল্যাবের চেয়ারম্যান এবং এশিয়ান হাসপাতালের ইউনিট-১ এর প্রধান ডা. সুব্রত আখৌরি বলেন, নারীদের হৃদরোগের লক্ষণগুলো প্রায়ই ভুলভাবে নির্ণয় করা হয়। বমি বমি ভাব, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট - এগুলোকে অন্য সমস্যা বলে ভুল করা হয়ে থাকে। নারীদের ধমনীতে ভিন্নভাবে প্লাক তৈরি হয়, যা রোগ নির্ণয়কে জটিল করে তোলে। মানসিক চাপ এবং বিষণ্নতা - যা নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এতে হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়াতে পারে।
ডা. সুব্রত কঠোর সতর্কবাতা দিয়ে বলেন, রোগীদের বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ‘অ-পরীক্ষিত হরমোন’ পরিবর্তনকারী অ্যান্টি এজিং ঝুঁকিপূর্ণ। এর প্রথম ও শেষ লক্ষণ হতে পারে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।
নিম্ন রক্তচাপ: একটি নীরব ট্রিগার
শেফালির ক্ষেত্রে সম্ভাব্য জটিলতাগুলোর মধ্যে একটি হতে পারে রক্তচাপের হঠাৎ হ্রাস। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের জন্য একটি পরিচিত ট্রিগার।
পুনের রুবি হল ক্লিনিকের কার্ডিওলজিস্ট ডা. অভিজিৎ খাদতারে বলেন, গুরুতর হাইপোটেনশন বা রক্তচাপের হঠাৎ এবং তীব্র হ্রাস একটি মেডিক্যাল জরুরি অবস্থা। এটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে অক্সিজেন থেকে বঞ্চিত করতে পারে, যার ফলে শক হতে পারে। এতে জীবন হুমকি অবস্থায় পড়ে।
তিনি বলেন হঠাৎ হাইপোটেনশনের কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
গুরুতর ডিহাইড্রেশন
সংক্রমণ থেকে সেপটিক শক
অ্যানাফিল্যাকটিক প্রতিক্রিয়া
হার্ট অ্যাটাক
ডা. অভিজিৎ বলেন, বিভ্রান্তি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, নাড়ি দ্রুত দুর্বল এবং ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, ঘামযুক্ত ত্বকের মতো লক্ষণগুলো কখনই উপেক্ষা করা উচিত নয়। মারাত্মক পরিণতি রোধ করার জন্য তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তত্ত্বাবধানের প্রয়োজনীয়তা
ভারতীয় পুলিশের সূত্র বলছে, শেফালি বহু বছর ধরে ডাক্তারের তত্ত্বাবধান ছাড়াই অ্যান্টি এজিং, মাল্টিভিটামিন এবং ত্বক সাদা করার প্রচুর ওষুধ নিয়ে আসছিলেন। মৃত্যুর ঘটনাটি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে ইঙ্গিত করে। পুলিশ শেফালির ঘরে, ফ্রিজে, ড্রয়ারে এবং টেবিলে প্রচুর পরিমাণে ওষুধ পেয়েছে, যার মধ্যে ‘গ্লুটাথিয়নের’ মতো অ্যান্টি এজিং ওষুধও ছিল।
একটি সূত্র জানিয়েছে, শেফালি প্রায় আট বছর আগে একবার ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করার পর নিজেই ওষুধ খাওয়া শুরু করেছিলেন। পরে কোনো চিকিৎসকের নিয়মিত তত্ত্বাবধান ছাড়াই এটি চালিয়ে যান।
মারেঙ্গো এশিয়া ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরো অ্যান্ড স্পাইনের চেয়ারম্যান এবং উত্তর ভারত অঞ্চলের প্রধান ক্লিনিক্যাল স্ট্র্যাটেজি ডা. প্রবীণ গুপ্ত অ্যান্টি এজিং চিকিৎসার সঙ্গে স্ব-ওষুধের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন।
তিনি বলেন, মানুষ ধরে নেয় অ্যান্টি এজিং উপায় নিরাপদ। এটি সত্য নয়। এই ওষুধের অনেকগুলো রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসের জন্য বিদ্যমান ওষুধের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে বিপজ্জনক হতে পারে।
তার জোর দাবি, এই পদার্থগুলো প্রায়ই নিয়মকানুন এবং মান পরীক্ষা উপেক্ষা করে অনলাইনে বিক্রি হয়।
শেষে তিনি বলেন, আমাদের অন্য চিকিৎসা পদ্ধতির মতোই অ্যান্টি এজিং পেশাদার চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করা উচিত। সঠিক স্ক্রিনিং ছাড়া এই তথাকথিত ‘যুব অমৃত’গুলো গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
শেফালি জারিওয়ালার মৃত্যু অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টি এজিং চিকিৎসার উত্থান ও এর ভয়াবহ পরিণতিকেই ইঙ্গিত করছে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম