
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যের ওপর প্রস্তাবিত ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করলেও, দেশের প্রধান রপ্তানি খাতটি এখনো প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান নিয়ে উদ্বেগে আছে। কারণ, ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় বাংলাদেশের সুবিধা খুব বেশি ভালো বলে মনে করছেন না রপ্তানিকারকেরা। খবর সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের।
তাদের মতে, মার্কিন শুল্ক হ্রাসের সিদ্ধান্তটি স্বস্তিদায়ক হলেও এটি পুরো সমস্যার সমাধান নয়, বরং সিদ্ধান্তটি প্রতিযোগিতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্র।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, নতুন হারে শুল্ক কমলেও এখনও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে মোট শুল্ক দাঁড়াচ্ছে ৩৬.৫ শতাংশ, যেখানে পূর্বের ১৬.৫ শতাংশ শুল্ক আগেই প্রযোজ্য ছিল।
তার মতে, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ এখন এক কাতারে থাকলেও ভিয়েতনামের তুলনায় এখনো পিছিয়ে।
উইন্টার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, 'নতুন শুল্ক হার কিছুটা স্বস্তি দিলেও মার্কিন ক্রেতাদের কাছে আমাদের পণ্যের দাম বাড়ছে, যা প্রতিযোগীদের তুলনায় আমাদের পিছিয়ে দেবে। ক্রেতারা এখন ভিয়েতনামের মতো বিকল্প খুঁজে নিতে পারেন যদি সেখান থেকে একই ধরনের পণ্য সস্তায় পান।'
বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, যার মাধ্যমে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি অর্জিত হয়। খাতটিতে চার মিলিয়নের বেশি কর্মী নিয়োজিত, যাদের বেশিরভাগই নারী।
কম খরচে বৃহৎ পরিসরে সাধারণ ও মাঝারি মানের পোশাক তৈরির কারণে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই সুবিধা এখন হুমকির মুখে। কারণ, লাভের পরিমাণ খুব কম এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমেই বাড়ছে।
চীন ও ভারত থেকে তুলা আমদানি করে স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করে খরচ কমানোর চেষ্টা করছে দেশের অধিকাংশ কারখানা। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত বাণিজ্য নীতি এই কৌশলকেও অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও ভিয়েতনামের মধ্যে হওয়া এক বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী, ভিয়েতনামের বেশিরভাগ পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক ধার্য হলেও অন্য দেশ থেকে আসা পণ্য ভিয়েতনামের মাধ্যমে রপ্তানি হলে তার ওপর ৪০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে। চুক্তির অংশ হিসেবে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি শুল্ক পুরোপুরি তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
অন্যদিকে, ভারত বর্তমানে ২৫ শতাংশ শুল্কের মধ্যে পড়লেও, ওয়াশিংটনের সঙ্গে চলমান আলোচনার ফলে সেটি ভবিষ্যতে কমে আসতে পারে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
ও.পি. জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, 'এটা ঠিক যে শুল্ক কমেছে, কিন্তু পরিস্থিতি এখনো অনুকূল নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা জরুরি।'
তিনি আরও জানান, এই শুল্ক হারের প্রভাব পুরোপুরি বোঝা যাবে প্রায় তিন মাস পরে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুল্ক কমানোর সুবিধা পেতে বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলোকে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে বোয়িং বিমানের সংখ্যা ১৪ থেকে বাড়িয়ে ২৫টি করার পরিকল্পনা করেছে।
এছাড়া, গত মাসে সই হওয়া একটি চুক্তি অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে ৭ লাখ টন গম আমদানি করবে বাংলাদেশ। এর আগে গমের প্রধান উৎস ছিল রাশিয়া ও ইউক্রেন।
লন্ডনভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক প্রিয়জিত দেবসরকার বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম কেনার দামে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া বোয়িং বিমানের সংখ্যা বাড়ানো হলেও প্রশ্ন থেকে যায়—এই অতিরিক্ত বিমান পরিচালনার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কি না। বেহাল অবস্থার মধ্যে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এই সিদ্ধান্ত থেকে আদৌ কোনো বাণিজ্যিক সুবিধা পাবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।'
গত বছরের এক গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত যেকোনো চুক্তি ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকার প্রত্যাহার করে নিতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
দেবসরকার বলেন, 'এই মুহূর্তে যা কিছু চুক্তি হচ্ছে, নির্বাচনের পর সেগুলো বাতিল হয়ে যেতে পারে। ফলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাণিজ্য সম্পর্কেও প্রভাব ফেলছে।'
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হ্রাস বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য স্বস্তির ইঙ্গিত দিলেও, এই খাতের সামনে চ্যালেঞ্জ থেকে যাচ্ছে বহুমাত্রিক—প্রতিযোগিতা, উচ্চ ব্যয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক চাপ।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম