
জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউসে ফেরার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি করাবেন বলে বহুবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তার পর থেকে যুদ্ধ আরো তীব্র হয়েছে এবং শান্তির সম্ভাবনা ক্রমে দূরে সরে গেছে। তবে তিনি সম্প্রতি দাবি করেছেন, ওই প্রতিশ্রুতি ছিল ব্যঙ্গাত্মক। কিন্তু শুক্রবার আলাস্কায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে বৈঠক কিছু রুশ নাগরিকের মধ্যে আশা জাগিয়েছে।
মস্কোর বাসিন্দা দামির গুরিন বলেন, ‘এটি সম্পর্কের পুনঃসূচনার সংকেত হতে পারে। আনুষ্ঠানিকভাবে, ওয়াশিংটনের হাতে একসঙ্গে নিষেধাজ্ঞা ও সীমাবদ্ধতা তুলে নেওয়ার সব আইনি ব্যবস্থা আছে, যা শতাব্দীর সেরা চুক্তির পথ খুলে দিতে পারে। এটি আর শুধু কূটনীতি নয়। এটি ভূরাজনৈতিক মানচিত্রের পুনরায় অঙ্কন।
অন্যরা আরো সন্দিহান। প্রতিশোধের ভয়ে পদবি না প্রকাশের অনুরোধ সেন্ট পিটার্সবার্গের অবসরপ্রাপ্ত নারী ক্যাথেরিন বলেন, ‘পুতিনের বুড়ো বয়সের জেদ আর ট্রাম্পের স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্যে, সব কিছু এখনো ১০০ বার বদলাতে পারে। ঈশ্বরের ইচ্ছায়, তারা যুদ্ধ বন্ধে রাজি হোক, অবশ্যই।’
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইউক্রেনে হামলা থামাতে পুতিনের অনিচ্ছার প্রতি ক্রমবর্ধমান হতাশা প্রকাশ করেছেন, কিয়েভে সাম্প্রতিক আক্রমণগুলোকে ‘ঘৃণ্য’ বলেছেন।
৩১ জুলাই রুশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের রাজধানীতে আঘাত হানলে ডজনখানেক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়, যা যুদ্ধ চলাকালীন সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাগুলোর একটি।
গত মাসে ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, ৫০ দিনের মধ্যে রাশিয়া লড়াই বন্ধ না করলে আরো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। জ্যেষ্ঠ রুশ রাজনীতিকদের উপহাস করা সেই সময়সীমা এখন শেষ হয়ে গেছে। নতুন নিষেধাজ্ঞাও কার্যকর হয়নি। তবে রুশ তেল কেনার শাস্তি হিসেবে গত সপ্তাহে ভারতকে ৫০ শতাংশ শুল্কে আঘাত করা হয়েছে।
তবু ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, শান্তিচুক্তি কাছাকাছি। হোয়াইট হাউসে শুক্রবার তিনি বলেন, ‘আমরা কিছু (ভূখণ্ড) ফেরত পাব। কিছু অদলবদল হবে। উভয়ের (রাশিয়া ও ইউক্রেনের) কল্যাণের জন্য কিছু ভূমি বদল হবে।’ তবে কার কাছ থেকে কোন ভূমি দেওয়া হবে, তা ব্যাখ্যা করেননি।
রসিকতা করে মস্কোর বাসিন্দা আন্যা বলেন, ‘আমি ইতিমধ্যে মিম দেখেছি যে আমরা আলাস্কার বিনিময়ে ক্রিমিয়া বদল করব।’
বাস্তব অগ্রগতি নয়, প্রতীকী বার্তা বেশি
বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি গবেষক ও রুশ রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ইলিয়া বুদ্রাইৎসকিসের মতে, যুদ্ধরত পক্ষগুলোর আপসহীন অবস্থান বাস্তব আপসের সম্ভাবনা ক্ষীণ করে তোলে। বরং আলাস্কা শীর্ষ সম্মেলনটি প্রতীকী গুরুত্ব বহন করবে বলে তিনি মনে করেন।
বুদ্রাইৎসকিস আলজাজিরাকে বলেন, ‘পুতিনের দিক থেকে, এটি বিশ্বে তার অবস্থানের পুনঃস্থাপন প্রদর্শন করে—তিনি মার্কিন ভূখণ্ডে এসে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেন, যিনি সম্মানের চিহ্ন দেখান। এটি স্পষ্ট যে এই বৈঠক কেবল অনুষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমেই রাশিয়ার জন্য প্রতীকী বিজয়, যদিও কেউ এর থেকে কোনো ফলাফল আশা করে না।’
‘এটি (পুতিনের) কৌশলের কার্যকারিতার প্রমাণ, যা হলো কোনো আপস করার প্রয়োজন নেই। কেবল নিজের সর্বোচ্চ দাবিগুলো বারবার পুনরাবৃত্তি করতে হবে এবং একসময় সবাই এতে এত ক্লান্ত হয়ে পড়বে যে তারা এগুলো মেনে নিতে বাধ্য হবে, আর রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাবে।’
বুদ্রাইৎসকিস মনে করেন, বৈঠকটি ট্রাম্পের জন্যও অনুরূপ মূল্য বহন করে। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া তাদের ভূখণ্ড ছেড়ে দেবে কি না, তা নিয়ে তার বিভ্রান্তির অর্থ, তিনি বৈঠকের কোনো অর্থবহ এজেন্ডাকে গুরুত্ব দেন না। ট্রাম্পের জন্য এই বৈঠকের প্রতীকী অর্থ হলো, দেখানো যে তিনি ইউক্রেন ইস্যুতে এখনো মূল ভূমিকা পালন করছেন, তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি পুতিনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন, যাকে পুতিন শোনেন ও সম্মান করেন।’
যদিও রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে আছে, ইউক্রেন আর কোনো রুশ ভূখণ্ড দখল করে নেই—পশ্চিম রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চল থেকে এই বছরের শুরুতে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে। ব্লুমবার্গ শুক্রবার জানিয়েছে, রুশ ও মার্কিন কূটনীতিকরা এমন একটি চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছেন, যা রাশিয়াকে এখন পর্যন্ত জয় করা ভূখণ্ড রাখতে দেবে এবং ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন ও জাপোরিঝিয়া এলাকায় বিদ্যমান যুদ্ধক্ষেত্রে আক্রমণ থামাতে বাধ্য করবে।
পোল্যান্ডের অনলাইন সংবাদপত্র অনেট জানিয়েছে, ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ পুতিনকে প্রস্তাব দিয়েছেন ক্রেমলিনের তথাকথিত ‘নতুন ভূখণ্ড’র কার্যত স্বীকৃতি দেওয়া এবং নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার জন্য। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রেমলিন ইউক্রেনের পূর্বে পুরো দনবাস অঞ্চল নিজেদের বলে দাবি করে। ইউক্রেন যদি এই শর্ত মেনে নেয়, তবে তাকে লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের যেসব অংশ এখনো তার নিয়ন্ত্রণে আছে সেখান থেকে সেনা সরাতে হবে।
জেলেনস্কি অনুপস্থিত, ইউরোপীয় দেশগুলোও বাইরে
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি শনিবার টেলিগ্রামে পাল্টা জবাবে বলেন, ‘ইউক্রেনীয়রা তাদের ভূমি দখলদারদের উপহার দেবে না।’
এদিকে জেলেনস্কি শুক্রবারের বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন না। দিগোরিয়া প্ল্যাটফরম থিংকট্যাংকের পরিচালক জাউরবেক খুগায়েভ বলেন, ‘শীর্ষ সম্মেলনটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ ও ইউক্রেনের অংশগ্রহণ ছাড়াই অনুষ্ঠিত হবে। এটি একটি স্পষ্ট সংকেত যে ট্রাম্প ও পুতিন—উভয়ই জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের ধ্বংসাত্মক অবস্থান বুঝতে পেরেছেন, যারা স্থায়ীভাবে ইউক্রেনীয় নেতাকে অনুষ্ঠানের এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছেন।’
বুদ্রাইৎসকিসের মতে, কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে, যা যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে গুরুতরভাবে ব্যাহত করবে না। তিনি বলেন, ‘সম্ভবত পুতিন কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ নেবেন, যেমন ইউক্রেনে বোমাবর্ষণ সীমিত করা বা সাময়িকভাবে বিরত থাকা। কারণ সামগ্রিকভাবে এই আকাশযুদ্ধ রুশ সেনাদের অগ্রগতিতে খুব বেশি সহায়তা করে না।’
যদিও পুতিন ও ট্রাম্প এই বছর কয়েকবার ফোনে কথা বলেছেন, তবে শুক্রবারের আলোচনা হবে ২০১৯ সালে জাপানের ওসাকায় সাক্ষাতের পর থেকে দুই রাষ্ট্রনেতার প্রথম মুখোমুখি বৈঠক। পুতিনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে কথিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য নয় বলে তাকে গ্রেপ্তার করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
আলোচনার বিস্তৃত পরিধি
দিগোরিয়া এক্সপার্ট ক্লাবের সদস্য ও রাজনৈতিক বিজ্ঞানী আলেক্সেই নেচায়েভ বলেন, শুক্রবারের আলোচনার একমাত্র বিষয় ইউক্রেন না-ও হতে পারে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এবং অবশ্যই বৈঠক যেহেতু আলাস্কায় হচ্ছে, তাই আর্কটিক সার্কেলও আলোচনায় থাকবে।
তিনি আরো বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার জন্য মূল বিষয় হলো, ইউরোপে নতুন নিরাপত্তা কাঠামো। মস্কো ইউক্রেন সংঘাতকে ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্কের বৃহত্তর সংকটের অংশ হিসেবে দেখে। এর মানে সমাধানের জন্য মূল কারণগুলো দূর করতে হবে, যার মধ্যে পূর্ব দিকে জোটের সম্প্রসারণ না করার বিষয়টি আইনিভাবে সুরক্ষিত করাও অন্তর্ভুক্ত।’
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম