
গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া নানা অপকর্মের ঘটনা ক্রমেই প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের দমনে বলপ্রয়োগ থেকে শুরু করে আটক করা এবং ছাত্র-জনতার উপর ব্যাপক গণহত্যার অনেক তথ্যই এখন উঠে আসতে শুরু করেছে। জুলাই গণহত্যার বিচার রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জবানবন্দিতে উঠে আসছে সেই সময়ের সরকারের ভেতরকার অজানা অনেক কর্মকাণ্ড।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবদুল্লাহ আল-মামুন জবানবন্দিতে বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) তৎকালীন প্রধান হারুন রশীদকে সমন্বয়কদের আটকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকের বিষয়ে হারুন রশীদ সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন এবং তাকে যথাযথ সমর্থন দিতেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম।
গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি এই মামলায় দোষ স্বীকার করে নিয়ে রাজসাক্ষী হয়েছেন। তিনি এই মামলার ৩৬তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
২০২২ সাল থেকে শেখ হাসিনার সরকারের পতন পর্যন্ত আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর আগে র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন। তিনি জবানবন্দিতে রাতের ভোট হিসেবে পরিচিত ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন, গুম, গোপন বন্দিশালা, জুলাই আন্দোলন দমনের বিভিন্ন কৌশল, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ভূমিকার কথা উঠে আসে।
সাবেক এই আইজিপি গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় তিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সারাদেশে সেনা মোতায়েন করা হয়। এরপর ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ধানমন্ডির বাসায় ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোর কমিটির বৈঠক হতো। বৈঠকে তাঁদের আন্দোলন দমনসহ সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হতো।
আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, এই কমিটির বৈঠকে তিনি, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাংগীর আলম, অতিরিক্ত সচিব টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তফা, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুন রশীদ, র্যাবের মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, ডিজিএফআই ও এনএসআইয়ের প্রধানেরা উপস্থিত থাকতেন।
কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটক করার সিদ্ধান্ত হয় বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, ডিজিএফআই এই প্রস্তাব দেয়। তিনি এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তিনি রাজি হন। আটকের দায়িত্ব ডিবিপ্রধান হারুনকে দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিজিএফআই ও ডিবি তাদের আটক করে। ডিবি হেফাজতে নিয়ে আসে।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে এনে আন্দোলনের বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আপস করার জন্য চাপ দেয়া হয়। তাদের আত্মীয়স্বজনকেও ডিবিতে নিয়ে এসে চাপ দেয়া হয়। সমন্বয়কদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে টেলিভিশনে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করা হয়।
এ ব্যাপারে ডিবিপ্রধান হারুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ডিবির তৎকালীন প্রধান হারুনকে ‘জিন’ বলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ডাকতেন উল্লেখ করেন সাবেক আইজিপি। তিনি বলেন, হারুন সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পারদর্শী ছিলেন।
এই সাবেক আইজিপি জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করা হয়েছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। আন্দোলন দমনে প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসায় বৈঠক হয়েছে। আন্দোলনপ্রবণ এলাকা ভাগ করে ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনা করা হয়েছে। শেখ হাসিনার নির্দেশে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে।
ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীতে দুটি গ্রুপ গড়ে উঠেছিল। একটির নেতৃত্ব দিতেন হাবিব ও আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন মনির। জবানবন্দিতে এমনই তথ্য তুলে ধরেছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
জবানবন্দিতে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশে রাজনৈতিক প্রভাব আরও বেড়ে যায়। প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন কিছু কিছু কর্মকর্তা। ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
তিনি বলেন, এসব কর্মকর্তা প্রায় রাতেই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠকে করতেন। গোপন সেসব বৈঠক গভীর রাত পর্যন্ত চলত। বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা হলেন- সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবিপ্রধান হারুন, এসবির মনিরুল, ডিআইজি নুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার, এএসপি কাফী, ওসি মাজহার, ফোরকান অপূর্বসহ আরো অনেকে। এর মধ্যে কারো কারো সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
স্থানীয় আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ফিরলো সুপ্রিম কোর্টের হাতেস্থানীয় আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ফিরলো সুপ্রিম কোর্টের হাতে
রাজসাক্ষী মামুন বলেন, সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকায় চেইন অব কমান্ড মানতেন না এসব কর্মকর্তা। কিন্তু আমি চাইতাম তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক। মূলত পুলিশ বাহিনীতে গড়ে তোলা দুটি গ্রুপই এসব কর্মকাণ্ড চালাত। এছাড়া দুই গ্রুপের নেতৃত্বদানকারীরা চাইতেন তাদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পাক এবং ঢাকায় থাকুক।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম