
কবি হাবীবাহ্ নাসরীন
‘কবির চোখে রাত নেমেছে নীল/ কাঁচপোকাদের আনন্দ ঝিলমিল’- শুরুতেই নিখুঁত স্বরবৃত্তে আর শুদ্ধ অন্ত্যমিলে হাবীবাহ্ নাসরীন তাঁর কবিতার ডালি খুলেছেন। এই সময়ের কবিদের কেউ কেউ যখন ছন্দ না জেনে ছন্দকে অস্বীকার করার ধৃষ্ঠতা দেখাচ্ছেন, তখন তিনি ছন্দকে অঙ্গীকার করেই কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। এ বড় সাহসের কথা। ৫৬টি কবিতার প্রতিটিই ছন্দমিলযুক্ত- এ বড় যোগ্যতার ব্যাপার। গানের স্বরলিপি যে তিনি আয়ত্ত করেছেন, সুরের সাতটি সুরই যে কণ্ঠে জুড়তে পারেন, এ তারই প্রমাণ। এরপর তার ডানা মেলে গান গাইতে সমস্যা হবে না।
এ কথা ঠিক যে ভাল ব্যাকরণ জানলেই সে শিল্পী হয়ে ওঠে না। ওস্তাদ হওয়া আর শিল্পী হওয়ার মধ্যে ফারাক আছে। সেই সত্যটুকু বুঝতে হবে একজন কবির। কথাগুলো বলছি এই কারণে যে ‘কবিতা আমার মেয়ে’ দেশ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৬) গ্রন্থে কোথাও-কোথাও কিছু সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ে। মাত্রাবৃত্তে ৬ মাত্রার চালে কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ে-
‘কচি কচি দেহ/ পুড়ে ছারখার,/ যায় না তো চেনা/ মুখ (৬+৬+৬+২)
মানবতা তুমি/ নিশ্চুপ কেন,/ তোমার কী অ/সুখ?’ (৬+৬+৫+২)
(কোন অপরাধে, পৃ. ১৯)
আবার একই কবিতায় দেখি-
কী অপরাধ,/ বলো কী অপরাধ?/ যার ফলে এত/ সাজা? (৫+৭+৬+২)
মানবতা আজ/ পলাতক কেন,/ বিধ্বস্ত কেন/ গাজা? (৬+৬+৭+২)
(কোন অপরাধে, পৃ. ১৯)
ছন্দের খেলায় নামতে গেলে একটু প্রস্তুতি তো রাখতেই হয়। এরকম স্খলন-পতন রয়েছে বেশ কিছু কবিতায়। অন্ত্যমিলের অসঙ্গতিও রয়েছে অনেক স্থানে। যেমন ‘কখন মরণ এলে’ কবিতায় লিখেছেন-
কখনো মরণ এলে
পৃথিবীটা ডেকে বলে
জীবনটা দেখ কত সুন্দর।
ফেরারি জাহাজ ছোটে
জানা বা অজানা ঘাটে
দুলে ওঠে হৃদয়ের বন্দর!
(কখনো মরণ এলে, পৃ. ৫১)
এখানে এলে/বলে, ছোটে/ঘাটে মিল শুদ্ধ নয়। এই কবিতায় এমন অসঙ্গতি রয়েছে শেষের অনুচ্ছেদের। ‘যতখানি পথ আঁকা/ ছুটে যাবে একা একা’- আঁকা আর একা-র মিল শুদ্ধ নয়। ধারণা করি এই সব মিলে যে শুদ্ধ নয়, সেটি হয়তো তাঁকে কেউ বলে দেননি। না হলে এই ধরনের ছোটখাটো বিচ্যুতি এড়ানো যে তাঁর পক্ষে সম্ভবপর, তা অন্য কবিতাগুলো পড়লেই অনুমান করা যায়।
হাবীবাহ্ নাসরীনের কবিতা এই আমার প্রথম পড়া। আর ‘কবিতা আমার মেয়ে’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। আমি চাইলেই বইয়ের চমৎকার প্রচ্ছদেও প্রশংসা আর ছাপা বাঁধাইয়ের গুণকীর্তন করে আলোচনাটি শেষ করতে পারতাম। কিন্তু তাতে প্রবল সম্ভাবনাময় এই কবির ক্ষতি হতে পারে। সে হয়তো ধরেই নেবে যে সবাই যখন প্রশংসা করেছে, তবে তাঁর সকল কাঁটা বুঝি দূর হলো। কিন্তু কবিতার দীর্ঘযাত্রার বন্ধুরতার কথা আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই অগ্রজের দাবি নিয়ে। এই যে কিছু ভুল ধরিয়ে দেয়া হলো, আশা করি এখান থেকে তাঁর নতুন ভাবনা তৈরি হবে। সেই দিনের সেই শুদ্ধতার জন্য অপেক্ষা করব। এই যে কিছু অন্ত্যমিলের অশুদ্ধতার কথা বলা হলো, এ থেকেও আশা করি তাঁর সচেতন হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
কবি যখন লেখেন ‘এমন তো তেই পারে, এমনও তো হয়/ মাঝে-মাঝে জিতে যায় কিছু পরাজয়’। তখন ভাল লাগে, কবির অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতে মান চায়। ছন্দে গরমিল থাকা সত্ত্বেও ‘জয়-পরাজয়’ নামের এই কবিতাটি বিষয় ও ভাবের গভীরতার কারণে উতড়ে যেতে চায়।
আবার ‘তোমার নামে হৃদয়’ কবিতাটি বেশ সম্ভবনার সৃষ্টি করে। কিন্তু শেষ চরণে যখন ‘এবার আমি তোমার নামে হৃদয় চুরির মামলা দেব’ বলে ওঠেন কবি, তখন বাংলা চলচ্চিত্রের ক্লিশে সংলাপের কথা মনে পড়ে যায়। এই কবিই যখন লেখেন-
‘সবচেয়ে দামি নিজের জীবন
তাই দিয়ে গেছে হেসে,
সেই থেকে জানি, মরে যাওয়া যায়
বাংলাকে ভালবেসে’।
--তখন আমরা আপ্লুত হই। কবির জানা তখন যে কেনো পাঠকের জানার সঙ্গে মিশে যায়। পাঠক হয়ে ওঠেন এই কবিতার সরল অনুরক্ত। এই কবিই যখন বলেন ‘কে ভেঙেছে কাচের চুড়ি, চোখের তারা/ মেয়ে আমি উড়নচন্ডী, সর্বহারা’ তখন আমরা অন্য এক চরিত্র দেখতে পাই, যার ভেতরে অপার সম্ভাবনা। ‘দুঃখ ও কবিতা’, ‘তারপর আমি’, ‘এইসব বিষণ্ন দিন’, ‘কবিতা আমার মেয়ে’ কবিতাগুলো বেশ ভাল।
আমার প্রত্যাশা হলো নিয়মিত চর্চায় এই সব ছোটখাটো ত্রুটি সারিয়ে ফেলা যায়। আর সেটা করতে পারলে কবি হাবীবাহ্ নাসরীন হয়ে উঠবেন তাঁর সময়ের সম্ভাবনাময় বড় কবি। কারণ তাঁর হাতে ছন্দ আছে, তাঁর পক্ষপাত আছে অন্ত্যমিলের প্রতি।
ড. তপন বাগচী: বিশিষ্ট কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও উপপরিচালক, বাংলা একাডেমি
রেডিওটুডে নিউজ/জেএফ