বৃহস্পতিবার,

২৮ মার্চ ২০২৪,

১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৃহস্পতিবার,

২৮ মার্চ ২০২৪,

১৪ চৈত্র ১৪৩০

Radio Today News

অভিযুক্ত ২৮৮ জন, গ্রেফতার -১৫৩ 

লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যা: এক বছরেই ২৫ মামলার চার্জশিট

বাকী বিল্লাহ

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

আপডেট: ০৭:৩৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

Google News
লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশি হত্যা: এক বছরেই ২৫ মামলার চার্জশিট

ফাইল ছবি (সংগৃহীত)

লিবিয়ায় মানব পাচারকারি চক্রের মাফিয়ারা ২৬ বাংলাদেশিকে তাদের আস্তানায় জিম্মি করে জনপ্রতি ১২ হাজার মার্কিন ডলার মুক্তিপণ দাবি করেছিল। এ মুক্তিপণের টাকার জন্য গোপন আস্তানায় বাংলাদেশিসহ কয়েকটি দেশের মানুষকে দফায় দফায় রড, পাইপ দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে। নির্যাতনে অচেতন হয়ে পড়লে তাদেরকে ইলেট্রিক শক দেয়া হত। নির্যাতনের ভিডিও পরিবারকে দেখিয়ে  মুক্তিপণ আদায় করা হত। নির্যাতনের সময় কেউ মারা গেলে আস্তানার পাশে লাশ রেখে অন্যদেরকে ভয় দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। 

লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে জিম্ম থাকা সুদানী ও নাইজেরিয়ান নাগরিকরা মিলে মাফিয়া চক্রের এক সদস্যকে আস্তানার ভিতরে পাল্টা মারপিট করে মেরে ফেলে। তখন অন্য মাফিয়া খবর পেয়ে আস্তানায় গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় এতে আস্তানার ভিতরে বহু জিম্মি হতাহত হয়। আর ঘটনাস্থলে ২৬ বাংলাদেশি মারা যান। আহত হয় আরও ১০ থেকে ১২ জন। সিআইডির তদন্তে নির্যাতনের এই ভয়াবহ কাহিনী বেরিয়ে আসছে। 

নিহতদের স্বজন,আহতদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেশীয় দালাল ও মানব পাচারকারি চক্রের বিরুদ্ধে ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি), শরিয়তপুর, মাদারীপুর, হবিগঞ্জ, ফরিদপুর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন স্থানে পরিবারের পক্ষ থেকে পৃথক ২৫টি মানব পাচারের মামলা দায়ের করা হয়েছে। করোনা মহামারীর সময় সিআইডির টিম টানা একবছর অনুসন্ধান ও তদন্ত চালিয়ে ২৮৮ জন আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারি চক্রের সদস্যকে চিহ্নিত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে পৃথকভাবে বিভিন্ন সময় এসব মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। 

চার্জশিটভুক্ত মানব পাচারকারিদের মধ্যে সিআইডির টিম ঢাকা ও ঢাকার বাহিরে বিভিন্ন জেলায় অভিযান চালিয়ে ১৫৩ মানব পাচারকারি ও দালাল চক্রের সদস্যদরকে গ্রেফতার করেছে।  চার্জশিটভুক্ত আরও ১৩৫ জন মানব পাচারকারি  এখনো পলাতক রয়েছে। তাদেরকে সিআইডির তদন্ত টিম খুঁজছে।
   
সিআইডির তদন্তকারি টিমের কয়েক জন কর্মকর্তা জানান, ২০২০ সালের ২৮ মে লিবিয়ার মিজদা শহরে এ বর্বরোচিত ঘটনায়  ২০২০ সালের জুন সালে একের এক মামলা দায়ের করা হয়।  গেল বছর  জুন থেকে শুরু করে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত  টানা এক বছর তদন্ত চালিয়ে ২৫টি মামলা তদন্ত কাজ শেষ করা হয়েছে। তদন্ত করে সিআইডির টিম নিহত ও নির্যাতিত এবং গুলি বিদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকাসহ মোট ৩৮জনসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে মামলার তদন্ত কাজ শেষ করেছেন।

মামলার আলামত হিসেবে টাকা লেনদেন, ব্যাংকের কাগজসহ বিভিন্ন বিষয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে আদালতে বিচারের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। লিবিয়া ট্রেজেডির ঘটনায় জড়িতদের এখন আদালতে আইনী প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম চলছে। পলাতকদেরকে ধরতে চলছে অভিযান। তবে করোনা মহামারীর কারণে সিআডির টিম তদন্ত কালে ঘটনাস্থলে যেতে পারেনি বলে ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন। 

লিবিয়ায় নির্যাতিত ভৈরবের জানু মিয়া সিআইডির তদন্তটিমের  কাছে বলেছেন, তিনি তার পরিচিত দালাল সোহাগ ও শ্যামলের সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার কথা বললে তারা বলে, লিবিয়ায় ভাল ভিসা দিয়ে পাঠানো যাবে। তাদের অফিস ঢাকার মতিঝিলে। এরপর সোহাগ ও শ্যামলের সঙ্গে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে লিবিয়া যাওয়ার চুক্তি করে।

চুক্তি মতে, ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর দালাল সোহাগ ও শ্যামল তাকে প্রথমে কোলকাতায় পাঠায়। পরে কোলকাতা থেকে বোম্বাই। এরপর দুবাই থেকে মিশর ও মিশর থেকে লিবিয়ার বেনগাজীতে  পাঠায়। বেনগাজীতে সোহাগ ও শ্যামলের  লিবিয়ার দালালরা  তাকে রিসিভ করে। লিবিয়ার গুয়ার নামক জায়গার একটি ক্যাম্পে  নিয়ে যায়।  ওই ক্যাম্পে দালাল সোহাগ ও শ্যামলের নিয়োজিত বাঙ্গালী  দালাল  রাহাত তার কাছ থেকে  ৭ দিনের খাবার বাবদ ৫০ ডলার নেয়। কিন্তু কোন কাজ দেয়নি। এরপর আরো ৫০ ডলার নেয়। তবুও কাজ দেয়নি। ক্যাম্পে ১৬ দিন থাকার পর  আরেক  দালালের  বাসায় নেয়।  ওই দালালের বাসায় এক সপ্তাহ থাকার পর কাজ দেয়। কিন্তু যে বেতন দেয়ার কথা ছিল তার থেকে অনেক কম বেতন দেয়। চুক্তি ছিল ২৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা।  কিন্তু বেতন দেয় ১৭ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকা দিবে বলে কাজ দিয়েছিল।

কিন্তু জানু মিয়া খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, লিবিয়ার ত্রিপোলীতে যেতে পারলে সেখানে বেতনভাতা বেশি পাওয়া যাবে।  দালাল তানজিরুল ৬০ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে নিয়ে যাবে। এরপর গত ২০২০ সালের ১৫ই মে সকালে ২টি মাইক্রোবাস যোগে তিনি সহ ২০ জন ত্রিপোলীতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ২০২০ সালের ১৬ই মে সকালে আরেকটি মাইক্রোবাস যোগে আরও ১০ জন তাদের সঙ্গে  যোগ দেয়। 

যাওয়ার সময় ২০২০ সালের ১৬ মে  মাগরিবের নামাজের পর একদল লোক রাস্তার মাঝখানে তাদের গাড়ি আটকায়। তাদের ২৯ জনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নামিয়ে তাদের আস্তানায় নেয়। সেখানে কোন খাবার দেয়নি। অন্য একটি  গ্রুপের  কাছে  তাদেরকে  বিক্রি করে দেয়। ওই আস্তানায় আগে থেকে ৯ জন বাংলাদেশিসহ আরও ১২০ থেকে ১৩০ জন ছিল। তাদের মধ্যে সুদানী ও নাইজেরিয়ান ছিল। ওই আস্তানার দালালদের অত্যাচারে মারা যাওয়া একটি লাশ  আস্তানার পাশ্বেই পড়েছিল। মানব পাচারকারিরা লাশ দেখিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে জনপ্রতি ১২ হাজার মার্কিন ডলার দাবি করে। এরপর ৪ পাচারকারি  লোহার রড, প্লস্টিকের পাইপ দিয়ে তাদেরকে এলোপাতাড়ি পিটায় এবং ইলেট্রিক শক দেয়। এ ভাবে প্রতিদিন তাদেরকে নির্যাতন করে। 

২৭ মে ২০২০  দুপুর ১২টার দিকে মাফিযাদের একটি গ্রুপ তাদেরকে মারধর করে চলে যায়। ২০২০ সালের ২৭ মে বিকেল ৪টার দিকে আবার মারপিট শুরু করলে মানবপাচারের শিকার ও আস্তায় জিম্মি সুদানী, গায়ানি ও নাইজেরিয়ানরা মাফিয়া চক্রের একজনকে ক্ষুদ্ধ হয়ে সবাই মিলে মারপিট করে মেরে ফেলে। তার মৃত্যুর খবর শুনে অন্য মাফিয়ারা পরে আস্তানার গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে। এতে বহু হতাহত হয়। ঘটনাস্থলে ২৬ জন বাংলাদেশি মারা যান। 

আর জানু মিয়াসহ ১২ জন বাঙ্গালী  মারাত্বক ভাবে  আহত হয়।  আহত জানু মিয়ার পেটে, পিঠে, উরুতে, পায়ের পাতায় মোট ৫টি গুলি লাগে। এরপর রক্তাক্ত অবস্থায় নিহত ও আহতদের রাস্তার পাশে ডাস্টবিনে ফেলে মাফিয়ারা চলে যায়। পরে এক লিবিয়ান তাদেরকে দেখে আইন শৃংখলা বাহিনীকে খবর দিলে তারা তাদেরকে উদ্ধার করে ত্রিপলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এরপর বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষ খবর পেয়ে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টম্বর দেশে ফিরে পরে গত অক্টোবর মাসে সিআইডিকে ঘটনার লিখিত বর্ণনা দিয়েছেন।

সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, সংঘবদ্ধ মানবপাচারকারি চক্র বেশী বেতনে বিদেশে চাকরী দেয়ার লোভ দেখিয়ে ঢাকা, ভৈরব, হবিগঞ্জ, মাদারীপুর রাজৈর, গোপলগঞ্জের মোকসেদপুর, ফরিদপুর, মাগুরা, ঢাকার কেরানীগঞ্জ, চুড়াডাঙ্গা ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমজীবী বেকার শ্রমিকদের কাছ থেকে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয়। এরপর তাদেরকে ঢাকায় জড়ো করে প্রথমে বেনাপোল দিয়ে ভারতের কোলকতায় নেয়া হয়। সেখানে কয়েকদিন হোটেলে রাখার পর  বিদেশী দালাল চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে  দুবাই,মিশর হয়ে লিবিয়ায় পাচার করে। লিবিয়ায় যাওয়ার পর তাদেরকে দালাল চক্রের আস্তানায় নিয়ে নির্যাতন ও ভিডিও করে বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে বর্বরোচিত নির্যাতন চালানো হয়।

যে কারনে নির্বিচারে হত্যা:

সিআইডি জানায়, দালালদের আস্তানায় দাবিকৃত টাকা নিয়ে তর্ক বিতর্কের এক পর্যায়ে সুদানী ও নাইজেরিয়ানদের হাতে দালাল মাফিয়া চক্রের এক সদস্য মারা যায়। খবর পেয়ে  মানব পাচারকারি মাফিয়া চক্রের অন্য সদস্যরা ক্ষিপ্ত হয়ে  আস্তানায় ঢুকে বৃষ্টির মত গুলি করে ২৬ জনকে হত্যা করে। আর গুলিবিদ্ধ হয়ে কেউ চোখ বন্ধ করে চুপ থাকে। সবাই মারা গেছে এমন ভেবে তাদের লাশ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে মাফিয়ারা পালিয়ে যায়। এ ভাবে নির্মম  হত্যাকান্ড ঘটে।

মানবপাচারকারি মাফিয়া চক্রের লিবিয়ায় কয়েকটি গোপন আস্তানা বা ক্যাম্প রয়েছে।  অভিযুক্ত তানজিল একটি ক্যাম্প পরিচালনা করে। দাদা নামে একজন আরেকটি ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করে। আব্দুল্লাহ নামে এক পাচারকারির ক্যাম্প রয়েছে। এ ছাড়াও মানব পাচারকারি দালাল হেল্লাল, জুলহাস ও পারভেজ টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশ পাঠায়। দেশে তাদের তাদের একাধিক একাউন্ট রয়েছে।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মাদারীপুরের অভিযুক্ত মানবপাচারকারি জুলহাস, হাজি কামালসহ অভিযুক্ত ৪২ জন ঘটনায় জড়িত বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। তাদের স্বীকারোক্তিতে মামলার এজাহারের বাহিরে অনেকের নাম বেরিয়ে আসছে। এরমধ্যে চার্জশিটে একজন একাধিক মামলার অভিযুক্ত আসামি। তাদেরকে চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

সিআইডি জানায়, চার্জশিটভূক্ত অভিযুক্ত উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলো, লিবিয়ায় বসবাসকারি মাদারীপুরের রাজৈর এলাকার আমির শেখ, মাদারীপুরের দিনু শেখ, নূর হোসেন শেখ, সমেদ শেখ, রাশিদা বেগম,মাদারীপুরের জুলহাস সর্দার রয়েছে। এছাড়াও যাত্রাবাড়ির রব মোড়ল,লিয়াকত শেখনীলফামারীর আব্দুল্লাহ রয়েছে। সব মিলিয়ে চার্জশিটভুক্ত ২৫ মামলার আসামি প্রায় ২৮৮ জন।

সিআইডির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন , সিআইডির অরগানাইজর্ড ক্রাইম শাখা (মানব পাচার প্রতিরোধ) করোনা মহামারীর মধ্যেও তারা তারা গত এক বছর  ধরে তদন্ত করে বিভিন্ন সময় ২৫টি মামলা চার্জশিট দিয়েছেন। তারা আশা করেন, বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে দেশের মানুষ আরো সচেতন হবে। অভিযুক্ত, চিহ্নিত দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে বা কেউ লোভে পড়ে অজানা পথে পাড়ি না জমায়। সুনিদিষ্ট চাকরী ও ভিসা নিয়ে  বিদেশ যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রয়োজনে সিআইডির মানবপাচা প্রতিরোধ সেলের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। 

সিআইডির মানব পাচার প্রতিরোধ সেলের ডিআইজি আব্দুল্লাহ হেল বাকী জানান, লিবিয়া হত্যাকান্ডের সকল মামলা অল্প সময়ের মধ্যে দেশজুড়ে তদন্ত করে ক্রিমিনাল এজেন্ট চক্রের তথ্য উদঘাটন করে আসামি চিহ্নিত করা হয়েছে। এর ফলে জনগন মানব পাচার সম্পর্কে আরও সচেতন হবে। আর কেউ যাতে মানব পাচারের খপ্পরে না পড়ে তার জন্য সিআইডি কাজ করে যাচ্ছে।    

রেডিওটুডে নিউজ/ইকে

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের