
রেড মিট বা গরুর মাংসের বিকল্প হিসেবে বহু পুষ্টিবিদেরাই মুরগি খাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।
মুরগির মাংস বরাবরই স্বাস্থ্যকর প্রোটিন উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। রেড মিট বা গরুর মাংসের বিকল্প হিসেবে বহু পুষ্টিবিদেরাই মুরগি খাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। দক্ষিণ ইতালির ৪,৮৬৯ জন মধ্যবয়সী মানুষের উপর পরিচালিত এই গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে ৩০০ গ্রাম বা তার বেশি পরিমাণে মুরগির মাংস খাওয়ার সঙ্গে সার্বিক মৃত্যুহার এবং হজমতন্ত্রের ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার একটি সম্পর্ক থাকতে পারে।
হেলথলাইনের প্রতিবেদনে গবেষণাটির বিস্তারিত উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, সপ্তাহে ৩০০ গ্রাম বা তার বেশি মুরগির মাংস খেলে সার্বিক মৃত্যুর ঝুঁকি ২৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে হজমতন্ত্রের ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়েছে ২.৩ শতাংশ, পুরুষদের ক্ষেত্রে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৬ শতাংশে।
এই গবেষণার ফলাফল পূর্ববর্তী বহু গবেষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 'মেডিটেরেনিয়ান ডায়েট'-এ মুরগি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রোটিন উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ডায়েটারি গাইডলাইন (২০২০-২০২৫) অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে ২৬ আউন্স পর্যন্ত প্রোটিনজাতীয় খাদ্য খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়, যার মধ্যে মুরগি, ডিম ও লিন মিট অন্তর্ভুক্ত। তবে মুরগির আলাদা সীমা নির্ধারিত নেই। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা নিজেরাই তাদের খাদ্যাভ্যাসের তথ্য দিয়েছেন, যা মনে রাখা ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া, তাদের শারীরিক কার্যকলাপ, জীবনযাপন পদ্ধতি ও মুরগির উৎস কী ছিল—সেই তথ্যগুলোর অনুপস্থিতিও গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণে সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: যুক্তরাষ্ট্রের লং বিচ মেডিকেল সেন্টারের টড ক্যানসার ইনস্টিটিউটের মেডিকেল ডিরেক্টর ড. নিলেশ এল ভোরা বলেন, “সম্ভবত প্রথমবারের মতো মুরগির মাংসকেও হজমতন্ত্রের ক্যানসারের একটি সম্ভাব্য ঝুঁকির উৎস হিসেবে ভাবা হচ্ছে।” ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট জনস ক্যানসার ইনস্টিটিউটের সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট ড. অ্যান্তন বিলচিক বলেন, “গবেষণাটি বেশ উদ্বেগজনক এবং আরও বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। আমরা এতদিন ধরে যে মুরগিকে নিরাপদ মনে করে খাচ্ছি, সেটি যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়, তাহলে বিষয়টি অবশ্যই চিন্তার।”
সব মুরগি এক নয়: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব ধরনের মুরগির মাংস সমান নয়। শিল্পভাবে উৎপাদিত মুরগিতে হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাছাড়া, মুরগি রান্নার পদ্ধতি ও তাপমাত্রা—এই দুটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ তাপে রান্না করলে এইচসিএ ও পিএএইচ নামক ক্ষতিকর যৌগ তৈরি হয়, যেগুলো ক্যানসারের সঙ্গে জড়িত। প্রসেসড পোল্ট্রি, যেমন—চিকেন সসেজ, হট ডগ, ডেলি টার্কি স্লাইস ইত্যাদিতে ব্যবহৃত সংরক্ষক উপাদানগুলোও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
তাহলে কি মুরগি খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে: বিশেষজ্ঞরা বলছেন একেবারেই না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসল বিষয় হলো ‘মাত্রা’ ও ‘পদ্ধতি’। হার্ট বিশেষজ্ঞ ও ডায়েটিশিয়ান মিশেল রাউথেনস্টেইন বলেন, সপ্তাহে প্রায় ২০০ গ্রাম (৭ আউন্স) পর্যন্ত লিন ও আনপ্রসেসড মুরগির মাংস নিরাপদ।” তিনি আরও বলেন, “রান্নার পদ্ধতিতেও সতর্ক থাকতে হবে। বেকিং, স্টিমিং বা কম তেলে রোস্ট করা স্বাস্থ্যকর বিকল্প।
ড. বিলচিক আরও বলেন, শুধু মুরগি নয়, অন্যান্য প্রোটিন উৎস যেমন মাছের ক্ষেত্রেও রান্নার ধরন গুরুত্বপূর্ণ। তাই ডায়েট পরিকল্পনার সময় খাদ্যের গুণগত মান, পরিমাণ ও রান্নার পদ্ধতি—সবকিছু বিবেচনায় রাখা উচিত।
মুরগির মাংস যে এতদিন নিরাপদ মনে করা হতো, সেই ধারণায় সাময়িক চিড় ধরালেও, এই গবেষণাটি এককভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য যথেষ্ট নয়। বরং এটি আরও গভীর ও বিস্তৃত গবেষণার পথ তৈরি করেছে। ততদিন পর্যন্ত মুরগি খান—তবে পরিমাণমতো, স্বাস্থ্যকর উপায়ে এবং সচেতন থেকে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম