বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ) ‘অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) রিপোর্ট ২০২৪-২৫’ প্রকাশ করেছে, যেখানে গত এক বছরে বিশ্লেষণ করা ৪৬ হাজার ২৭৯টি রোগীর নমুনার ভিত্তিতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ উপলক্ষ্যে সোমবার আয়োজিত অনুষ্ঠানে জানানো হয়, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, অ্যামোক্সিসিলিন, সেফট্রিয়াক্সন, জেনটামাইসিন ও মেরোপেনেমসহ বহু অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা দ্রুত কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএমইউ) পরিচালিত এক বছরের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চিকিৎসা নিতে আসা চার রোগীর মধ্যে একজনের দেহে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে।
বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ উপলক্ষে গতকাল সোমবার বিএমইউর মিল্টন হলে প্রকাশিত হয় অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) প্রতিবেদন ২০২৪ ২৫। এ জন্য বায়োলোজি বিভাগ গত এক বছরে ৪৬ হাজার ২৭৯টি রোগীর নমুনা বিশ্লেষণ করে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অ্যামোক্সিসিলিন, সেফট্রিয়াক্সোন, জেন্টামাইসিন থেকে শুরু করে মেরোপেনেম ও টিগেসাইক্লিনের মতো শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারাচ্ছে।
সালমোনেলা টাইফি গ্রাস ৩১% থেকে বেড়ে ৮৩.৪%
রক্তে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া সালমোনেলা টাইফি। এর চিকিৎসায় অ্যাজিথ্রোমাইসিনকে সাধারণত শেষ দিকের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে ধরা হয়। গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, সালমোনেলা টাইফি গ্রাসের হার ২০২২ সালের ৩১ শতাংশ থেকে বেড়ে এবার ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এই অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা দ্রুত হারাচ্ছে।
ক্লেবসিয়েলা ও অ্যাসিনিটোব্যাক্টরের ওষুধ প্রতিরোধ বৃদ্ধি
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সেফট্রিয়াক্সোন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও জেন্টামাইসিনের ক্ষেত্রে ক্লেবসিয়েলার গ্রাস ২০২২ সালে ৫০ শতাংশের নিচে থাকলেও এবার তা ৮০ শতাংশেরও বেশি হয়েছে। সেফট্রিয়াক্সোন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও জেন্টামাইসিনের ক্ষেত্রে অ্যাসিনিটোব্যাক্টরের গ্রাস ২০২২ সালের ৩৫ শতাংশের নিচ থেকে বেড়ে এখন ৬০ শতাংশেরও বেশি। অন্যদিকে, এসচেরিশিয়া কোলাইর ক্ষেত্রে কিছু অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ কিছুটা কমলেও এখনও ৫৫-৭৪ শতাংশের উচ্চমাত্রায় রয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসকদের অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করা, রোগীদের পূর্ণ কোর্স না করা, পশুপালন ও মৎস্য খাতে অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, হাসপাতালগুলোতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন এবং নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স বেড়েছে। এতে চিকিৎসা জটিল হয়ে পড়েছে, সুস্থতায় লাগছে বেশি সময় এবং বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমইউর সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহেদা আনোয়ার। তিনি জানান, বিশ্লেষণ করা মোট নমুনার ২৪ শতাংশ (১১ হাজার ১০৮টিতে) বিভিন্ন ধরনের জীবাণু পাওয়া গেছে। এই জীবাণু অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী করে তোলে। এটি মূলত ওষুধের ভুল ব্যবহার বা অতিরিক্ত ব্যবহারে ঘটে। এর ফলে অণুজীবগুলো নিজেদের পরিবর্তন করে ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে এবং সাধারণ সংক্রমণও প্রাণঘাতী হতে পারে।
অনুষ্ঠানের সভাপতি অধ্যাপক ডা. আবু নাসের ইবনে সাত্তার প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক না কেনা, নিয়মিত হাত ধোয়া, টিকাদান, নিরাপদ খাদ্য প্রস্তুত এবং হাসপাতালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া, অসম্পূর্ণ ডোজ এবং প্রাণিসম্পদে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহারে জীবাণুগুলো ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এর ফলে যে রোগ আগে সহজে ভালো হয়ে যেত, এখন সেই রোগও চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ সংক্রমণ জটিল হয়ে যায়, খরচ বেড়ে যায়, আইসিইউতে ভর্তি থেকে শুরু করে মৃত্যু– এ সবই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারে।
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত এই সমস্যা মোকাবিলায় সবাইকে দেরি না করে এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রধান অতিথি বিএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, সমস্যার দায় ও সমাধানের দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের ক্ষেত্রে গবেষণা, গাইডলাইন প্রণয়ন, বাস্তবায়নে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিএমইউকে নেতৃত্ব দিতে হবে। আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আইইডিসিআরের সতর্কবার্তা
বিএমইউর এই প্রতিবেদন এমন সময় প্রকাশিত হলো, যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও আইইডিসিআর দেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সতর্ক করেছে। সম্প্রতি ডব্লিউএইচও জানায়– বিবিধ জীবাণু যখন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের প্রতি সাড়া দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তখন চিকিৎসা কঠিন কিংবা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে গুরুতর অসুস্থতা, অক্ষমতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

