
গুম, গোপনে বন্দি রাখা ও নির্যাতন চালানোর অভিযোগে বাংলাদেশে ২৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। ‘বহু প্রতীক্ষার পর ন্যায়বিচারের পথে বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়েছে’ বলেও মনে করে সংস্থাটি।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ সাবেক ও বর্তমান কয়েক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরপরই বৃহস্পতিবার এক সংবাদ প্রতিবেদনে এ প্রতিক্রিয়া জানায় এইচআরডব্লিউ।
সংস্থাটির এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলির লেখা প্রতিবেদনটির শিরোনাম– ‘ন্যায়বিচারের পথে এক ধাপ এগোল বাংলাদেশ’। তবে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এখনও ঘটছে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলো রয়ে গেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন তিনি।
প্রতিবেদনের শুরুতে ২০১৭ সালে এইচআরডব্লিউ প্রকাশিত অন্য একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গোপনে আটক রাখা ও গুম নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সেই প্রতিবেদনকে ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং দাবি করেছিলেন, বেশির ভাগ ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তি গ্রেপ্তারের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো অপরাধী, ঋণখেলাপি কিংবা প্রতারক। মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, আমার জোর দাবির কারণে তখন আসাদুজ্জামান খান তদন্তের আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত কোনো তদন্ত হয়নি।
তিনি লিখেছেন, শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা আরও শক্তিশালী হয়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন আসাদুজ্জামান খান। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও বাক্স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ সম্পর্কে এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় সরকার সাধারণত সেগুলো অস্বীকার করত বা মিথ্যা আশ্বাস দিত।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব দমনপীড়ন ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। টানা তিন সপ্তাহ ছাত্র-জনতার তীব্র বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এই আন্দোলনে প্রায় এক হাজার ৪০০ জন প্রাণ হারান। এরপর শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান ও বেশ কয়েক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। সরকারের উদ্যোগে গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সেখানে কমপক্ষে এক হাজার ৮৫০টি অভিযোগ জমা পড়ে।
তদন্তে দেখা যায়, তিন শতাধিক ব্যক্তি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে থাকা অবস্থায় নিহত হয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি কমিশন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্রও প্রকাশ করেছে, যেখানে কমিশনের অনুসন্ধানে পাওয়া নৃশংসতার ভয়াবহ বর্ণনা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের শাসনকালে ঘটে যাওয়া গুমের ঘটনাগুলোর বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। দুটি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খানসহ সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তা মিলিয়ে মোট ২৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
প্রতিবেদনের উপসংহারে মীনাক্ষী গাঙ্গুলি লিখেছেন, মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমরাও এমন মুহূর্তের অপেক্ষায় থাকি। তবু প্রায়ই মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তদের বিচার করা হবে। তবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলো রয়ে গেছে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম