ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেছেন, রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় পুলিশ অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই-চার জন মারা যেত। এরপর পুলিশের ওপর পালটা আক্রমণ হতো। এ কারণে সেদিন পুলিশ অ্যাকশনে যায়নি। গতকাল সোমবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এসব ঘটনা ঠেকাতে ডিএমপি সক্ষম না অক্ষম—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা সক্ষম। সব সময় সব ঘটনা আমরা কাভার করতে পারব বিষয়টা এমন না।’
তার মানে সেদিন আপনারা কোনো অ্যাকশনে যাননি—এমন প্রশ্নে ডিএমপির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘যতটুকু প্রয়োজন মনে করেছি, যতটুকু আমাদের অবস্থা ছিল। সর্বোচ্চ অ্যাকশন গুলি করা পর্যন্ত যেতে পারতাম আমরা কিন্তু তা আমরা অ্যাভয়েড করার চেষ্টা করেছি। কারণ চার-পাঁচ হাজারের মতো যে জনতা ছিল সেখানে ৫০-১০০ জন ফোর্স নিয়ে অ্যাকশনে গেলে আমার পুলিশ ও পাবলিক উভয়ের ক্যাজুয়ালিটি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।’ তিনি বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থান-কাল-পাত্রভেদে অ্যাকশন নিতে হবে। ইচ্ছা করলেই সব জায়গায় ফায়ার ওপেন করতে পারব না, এটা উচিতও না।
গুলির আগে যেসব বিষয় থাকে পুলিশ সেগুলো কেন করেনি—এমন প্রশ্নের উত্তরে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘গ্যাস মারা, সাউন্ড গ্রেনেড মারা ওখানে সেই পরিস্থিতি ছিল না। পরবর্তী সময় যদি কোনো ঘটনায় ৫-১০ হাজার লোক হয় সেখানেও কি আপনারা ব্যর্থ হবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি অ্যাডভানস ইনফরমেশন পাই সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঘটনাগুলো ঘটার আগে খুব সুপরিচিত ব্যক্তিরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলছে ‘ওখানে যাও যেয়ে ভেঙে আসো, আগুন দিয়ে আসো।’ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কি না—জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, ভুল তথ্য যখন প্রচার হচ্ছে তখন কাউন্টার প্রচার যদি সাংবাদিকরা করেন তাহলে জনগণ সচেতন হবে।
১৭ জন জেলে, ৩১ জন শনাক্ত :দৈনিক প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় সন্ত্রাস বিরোধী আইনে করা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ১৭ জনকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। এদের মধ্যে গতকাল সোমবার ১৫ জনকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল রানা তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। অন্য দুই জনকে এর আগে জেলে পাঠানো হয়।
অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন নজরুল ইসলাম গতকাল জানিয়েছেন, প্রথম আলোর অফিসে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩১ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। ডিসি মিডিয়া তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, আটকদের মধ্যে ১৫ জনকে গতকাল ও বাকি দুই জনকে এর আগে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন বিচারক।
গতকাল কারাগারে যাওয়া আসামির হলেন, মো. নাইম ইসলাম (২৫), মো. সাগর ইসলাম (৩৭), মো. আহাদ শেখ (২০), মো. বিপ্লব (২০), মো. নজরুল ইসলাম ওরফে মিনহাজ (২০), মো. জাহাঙ্গীর (২৮), মো. সোহেল মিয়া (২৫), মো. হাসান (২২), মো. রাসেল (২৬), মো. আব্দুল বারেক শেখ ওরফে আলামিন (৩১), মো. রাশেদুল ইসলাম (২৫), মো. সাইদুর রহমান (২৫), আবুল কাশেম (৩৩), মো. প্রাপ্ত সিকদার (২১) ও মো. রাজু আহমেদ (৩৩)।
গত ১৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাত আনুমানিক ১১টা ১৫ মিনিট থেকে ১৯ ডিসেম্বর রাত ২টা ৩০ মিনিটের মধ্যে অজ্ঞাতনামা কয়েক হাজার লোক বেআইনিভাবে সমবেত হয়ে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত দৈনিক প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনায় দণ্ডবিধি, বিশেষ ক্ষমতা আইন, সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশ ও সন্ত্রাস বিরোধী আইনে তেজগাঁও থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।
অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন নজরুল ইসলাম জানান, ঘটনার পর গত রবিবার প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ মামলা করে। ডেইলি স্টারের মামলা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ শেষে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দুই প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনায় জড়িতদের থানা পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থা সিসিটিভি ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে শনাক্তে কাজ করছে।
তিনি জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মো. নাইম (২৬) দেড় লাখ টাকা লুট করেছেন। সেই টাকা দিয়ে সে টিভি ও টাচ স্ক্রিন ফ্রিজ কিনেছে। তার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা, টিভি ও ফ্রিজ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারদের রাজনৈতিক পরিচয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আমি খুঁজতে চাচ্ছি না। এরা দুষ্কৃতিকারী। তারা আইন ভঙ্গ করছেন। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রচলিত যে আইন, যে বিচারব্যবস্থা, সে বিচারব্যবস্থায় তাদের বিচার নিশ্চিত করা হবে। অপরাধী যে দলেরই হোক বা যে মতাদর্শেরই হোক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
গণহারে গ্রেপ্তারের অভিযোগ :প্রথম আলোর করা মামলার শুনানিতে গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসামিপক্ষের কৌঁসুলি হোসেন আহাম্মদ, এমদাদউল্লাহ মোল্লাহ ও মো. আব্দুল্লাহ বলেন, এই ঘটনায় তদন্ত কর্মকর্তা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেননি। গণহারে আসামিদের গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। কোনোভাবেই আসামিরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এমনকি কোনো ভিডিও ফুটেজেও আসামিদের দেখা যায়নি। তারা আরো বলেন, ‘মামলার এক আসামি আব্দুল বারেক একজন রিকশাচালক। তাকে রাস্তা থেকে ধরে আনা হয়েছে। এছাড়া যার বিরুদ্ধে টাকা লুট করে টিভি ও ফ্রিজ কেনার অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটিও মিথ্যা। সেগুলো নিজের টাকায় কেনা ছিল এবং এর রসিদও রয়েছে।’ আইনজীবীরা বলেন, গ্রেপ্তার আসামিরা কেউ দিন মজুর, কেউ রিকশাচালক। বিনা কারণে তাদের ধরে আনা হয়েছে।
এর আগে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, আসামিদের অনেকেই ঘটনাস্থলে লাইভ করেছে, যা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। এছাড়া বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়াতেও বিষয়টি এসেছে। সুতরাং তাদের এমনিতেই গ্রেপ্তার করা হয়নি। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ ও লাইভ দেখে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। একপর্যায়ে আসামিরা একযোগে আদালতে বলেন, ‘আমাদের কোনো অপরাধ নেই। সার্চ করে দেখেন, অপরাধ পেলে শাস্তি দেন।’
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

