ফরাসি চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী ও বিশ্বখ্যাত আইকন ব্রিজিত বার্দো ৯১ বছর বয়সে মারা গেছেন। রোববার তার প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এই খবর জানানো হয়। ১৯৫৬ সালে 'অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান' ছবিতে খালি পায়ে ‘মামবো নেচে’ রাতারাতি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন তিনি। তবে শেষ জীবনে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন পশু অধিকাররক্ষা এবং উগ্র-ডানপন্থী অবস্থানের জন্য।
১৯৩৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্যারিসের এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম বার্দোর। ছোটোবেলায় লাজুক বার্দো ১৫ বছর বয়সেই 'এলে' ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে জায়গা করে নেন, যা তাকে মডেলিং থেকে সিনেমার জগতে নিয়ে আসে। ১৯৫৬ সালে স্বামী রজার ভাদিমের পরিচালনায় 'অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান' ছবিতে তার অবাধ্য চুলের স্টাইল এবং তীব্র যৌন আবেদনময়ী উপস্থিতি তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকের ফ্রান্সের এক জীবন্ত প্রতীক।
বিখ্যাত নারীবাদী দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার ১৯৫৯ সালে বার্দো সম্পর্কে লিখেছিলেন, বার্দো কাউকে কেলেঙ্কারিতে ফেলার চেষ্টা করে না, সে কেবল তার প্রবৃত্তি অনুসরণ করেন। ক্ষুধা লাগলে সে খায় এবং অত্যন্ত সহজভাবে প্রেম করে।
খ্যাতির বিড়ম্বনা ও বিষণ্নতা
প্রভাবশালী তারকা হওয়া সত্ত্বেও বার্দোর ব্যক্তিগত জীবন ছিল নিঃসঙ্গতায় ঘেরা। তিনি নিজেকে নিজের খ্যাতির খাঁচায় 'বন্দি' মনে করতেন। চারবার বিয়ে, একাধিক প্রেম এবং গভীর বিষন্নতার সাথে আজীবন লড়াই করেছেন তিনি। ২৬তম জন্মদিনে আত্মহত্যার চেষ্টার পর তাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। তিনি একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমি খুব সুখী, খুব ধনী, খুব সুন্দরী এবং বিখ্যাত ছিলাম, আবার একই সাথে আমি খুব অসুখীও ছিলাম।
অভিনয়ের পাশাপাশি সংগীত জগতেও তিনি সফল ছিলেন। গায়ক সার্জ গেইনসবুর্গের সাথে তার গাওয়া একটি বিশ্বজুড়ে যেমন প্রশংসিত হয়েছিল, তেমনি বিতর্কও তৈরি করেছিল।
পশুদের জন্য জীবন উৎসর্গ
১৯৭৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ৪২টি ছবিতে কাজ করার পর চলচ্চিত্র জগতকে 'পচা' আখ্যা দিয়ে বিদায় জানান বার্দো। এরপর তিনি স্থায়ী হন সেন্ট-ট্রোপেজ রিসোর্টে। সেখানে তিনি নিজেকে পুরোপুরি পশু অধিকার আন্দোলনে বিলিয়ে দেন। ১৯৮৬ সালে তিনি 'ব্রিজিত বার্দো ফাউন্ডেশন' প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্নগুলো নিলামে তুলে অর্থ সংগ্রহ করেন। তিনি একবার বলেছিলেন, আমি আমার সৌন্দর্য ও যৌবন পুরুষদের দিয়েছি, এখন আমার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা পশুদের দেব।
রাজনীতি ও বিতর্কিত অবস্থান
জীবনের শেষ কয়েক দশকে বার্দোর রাজনৈতিক মন্তব্য তাকে তীব্র বিতর্কের মুখে ফেলে। অভিবাসন, ইসলাম এবং সমকামিতা নিয়ে তার মন্তব্যের কারণে ১৯৯৭ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ফরাসি আদালত তাকে ছয়বার জরিমানা করে। একবার মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে তাকে ১৫,০০০ ইউরো জরিমানা করা হয়।
১৯৯২ সালে তিনি উগ্র-ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের উপদেষ্টা বার্নার্ড ডি’রমালকে বিয়ে করেন এবং দলটির নেতাদের প্রকাশ্য সমর্থন দেন। ম্যারিন লে পেনকে তিনি 'একবিংশ শতাব্দীর জোন অফ আর্ক' বলে অভিহিত করেছিলেন।
শেষ সাক্ষাৎকার
২০২৫ সালের মে মাসে বিএফএম টিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি নিজেকে যৌন বিপ্লবের প্রতীক মনে করেন কি না, জবাবে তিনি বলেছিলেন, না, কারণ আমার আগেও অনেক বন্য কাণ্ড ঘটেছিল। নারীবাদ আমার বিষয় নয়, আমি পুরুষদের পছন্দ করি।
নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে তিনি আরও বলেন, আমি সিনেমা নিয়ে ভাবি না, তবে একে প্রত্যাখ্যানও করি না। কারণ এই সিনেমার জন্যই আজ সারা বিশ্ব আমাকে চেনে এবং আমি পশুদের রক্ষা করতে পারছি।
বার্দোর মৃত্যুর সঠিক কারণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তার প্রয়াণে ফরাসি সংস্কৃতি ও বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের অবসান ঘটল।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

