এবার ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার গল্পটা সত্যিই হচ্ছে বিএনপির জন্য। আজ বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার পথে রওনা হবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ১৭ বছর পর নেতার বাড়ি ফেরা নিয়ে উচ্ছ্বসিত নেতাকর্মীরা।
দলটির নেতারা বলছেন, আগামীর সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমানকে বরণে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় আসছেন দলটির তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। বলা যায়, তারেক রহমানের ঘরে ফেরা নিয়ে চারদিকে সাজ সাজ রব।
ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে দেশের মাটিতে পা রাখছেন তারেক রহমান। দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ হতে চলায় বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্র সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা বিরাজ করছে।
এরই মধ্যে নিজ উদ্যোগে ঢাকায় আসা শুরু করেছেন জেলা ও উপজেলার নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।
বিএনপি তৃণমূলের এই ঢাকামুখী জনস্রোতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য শৃঙ্খলা কমিটি ও স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করেছে দলটি। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্বাগত মিছিল ও প্রস্তুতির সভা চলছে। বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে ১০টি রুটে।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, দীর্ঘ ১৭ বছরের বিরতির পর আগামী ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেদিন তার সংবর্ধনায় অর্ধকোটি মানুষের মহামিলন হবে। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই দীর্ঘ দেড় দশকের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটবে। স্বাভাবিকভাবেই নেতাকর্মীরা এখন আরো বেশি উচ্ছ্বসিত এবং উদ্দীপ্ত।
যাত্রা ও সফরসঙ্গী
তারেক রহমান ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করবেন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার, ২৫ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে। তার এ যাত্রা সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক ঘণ্টা বিরতির পর সম্পন্ন হবে।
সফরসঙ্গী হিসেবে যারা থাকবেন
তারেক রহমানের সঙ্গে বিমানে তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান, মিডিয়া টিমের প্রধান আবু আবদুল্লাহ সালেহ, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আবদুর রহমান সানি ও তাবাসসুম ফারহানা থাকবেন।
বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। এরপর তিনি বনানী ও কাকলী হয়ে সরাসরি সংবর্ধনাস্থলে ৩০০ ফিটে যাবেন। সংবর্ধনা শেষে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়াকে দেখতে যাবেন এবং সেখান থেকে গুলশানে মায়ের বাসায় উঠবেন।
নিরাপত্তা ও যানবাহন
তারেক রহমানের নিরাপত্তার জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ি কিনেছে বিএনপি, যা এরইমধ্যে দেশে পৌঁছেছে। এছাড়াও টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার প্রাডো এলসি ২৫০ মডেল গাড়ি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে এবং বাংলাদেশে নিবন্ধিত হয়েছে।
নিরাপত্তার জন্য একাধিক আগ্নেয়াস্ত্রের অনুমতি
তারেক রহমান বিমানবন্দর থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার সময় পাবেন পুলিশ প্রটেকশনসহ বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এছাড়া তারেক রহমানের বাসভবন ও অফিসেও থাকবে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা। নিরাপত্তা ছাড়পত্র ছাড়া কাউকে তার ধারেকাছে ভিড়তে দেবে না পুলিশ। ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও ছদ্মবেশে গোয়েন্দারা তারেক রহমানের নিরাপত্তার দিকটি দেখভাল করবেন।
পাশাপাশি বিমানবন্দর থেকে গুলশান পর্যন্ত দলের পক্ষ থেকে তারেক রহমানের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এ কে এম শামছুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার নেতৃত্বে চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্সসহ একাধিক টিম কাজ করবে। এ ছাড়া দলের বিশ্বস্ত নেতাকর্মীদের সমন্বয়েও একটি টিম গঠন করা হয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসা পর্যন্ত তারেক রহমানকে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা দিতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবারও (২৩ ডিসেম্বর) গুলশানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকতা ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. শামসুল ইসলাম শামস বৈঠক করেছেন।
সংবর্ধনার মঞ্চ
বিশ্বরোড থেকে পূর্বাচলমুখী ৩০০ ফিট সড়কের একটি অংশজুড়ে মঞ্চ তৈরির কাজ চলছে। বুধবার রাতের মধ্যে মঞ্চ তৈরির কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ৪৮ ফুট দীর্ঘ, ৩৬ ফুট প্রশস্ত ও সড়ক থেকে ৮ ফুট উঁচুতে এ মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। প্রায় ৯০০ মাইক লাগানো হবে রাজধানীতে। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে আবদুল্লাহপুর, বিশ্বরোড, বনানী হয়ে মহাখালী, যমুনা ফিউচার পার্ক, ৩০০ ফিটের রাস্তা ধরে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত লাগানো হচ্ছে এসব মাইক। পুরো এলাকা সিসি টিভির নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
তারেক রহমানের সংবর্ধনার মঞ্চে সঙ্গে থাকবেন তার সহধর্মিনী ডা. জুবাইদা রহমান, তার মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা, যুগপৎ আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ও দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা।
এদিকে, মঞ্চের সামনে ও দুই সাইডের নিরাপত্তার জন্য ২৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত বিশেষ ব্যারিকেড থাকবে। ব্যারিকেডের বাইরে উভয় পাশে নেতাকর্মীরা তারেক রহমানকে শুভেচ্ছা জানাবেন।
শহরজুড়ে থাকবে এলইডি ডিসপ্লে
সংবর্ধনাস্থলের বাইরে নেতাকর্মীদের ঢল ৩০০ ফিট ছাড়িয়ে বিমানবন্দর সড়কে উত্তরা-বনানী পর্যন্ত যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই লক্ষ্যে দলটি সংবর্ধানস্থল ও আশপাশের সড়কে ৯ শতাধিক মাইকের ব্যবস্থা রাখছে। পাশাপাশি শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ডিজিটাল এলইডি ডিসপ্লে স্থাপন করবে।
মেডি ক্যাল টিম
জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য ৩০টি মোবাইল মেডিক্যাল টিম গঠন হয়েছে। বিমানবন্দর ও ৩০০ ফিট এলাকার আশপাশের হাসপাতাল প্রস্তুত থাকবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তারেক রহমানের আগমনে লাখ লাখ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ঢাকায় সমাগম করবে। জরুরি চিকিৎসার জন্য আমরা কাজ করব। সংবর্ধনায় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা আমাদের অগ্রাধিকার।’
জেলা ও বিভাগের নেতাকর্মীরা যা বলছেন
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট বিলকিস জাহান শিরীন বলেন, ‘আমরা ঢাকায় যাওয়ার জন্য ৩০টি লঞ্চ ও এক শর বেশি বাস ভাড়া করেছি। মহিলাদের জন্য আলাদা কেবিনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নেতাকর্মীদের মধ্যে ঈদের মতো আমেজ কাজ করছে। সবাই উদগ্রীব, নেতাকে দেখার জন্য। একটাই লক্ষ্য, ঢাকায় যাওয়া।’
বাগেরহাট জেলা বিএনপি সাবেক সভাপতি এমএ সালাম বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী হতে আমরা নেতাকর্মীদের ঢাকামুখী করছি। নিজ উদ্যোগে অনেকে ঢাকায় চলে আসছে। আমরা সবাইকে সহযোগিতা করছি।’
যশোর জেলার অভয়নগর থানা জাসাসের সাধারণ সম্পাদক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমরা প্রায় এক হাজার নেতাকর্মী নিয়ে ঢাকামুখী হবো। অনেকে হোটেলে অবস্থান করবেন, আজ রাত ৯টার দিকে বাস ও ট্রেনে রওয়ানা দেবেন তারা।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাত্রদল ও যুবদলের নেতা মো. হাসান ইমতিয়াজ বলেন, ‘বেশিরভাগ নেতাকর্মী নিজস্ব উদ্যোগে ঢাকায় যাচ্ছেন। যুবদলের পক্ষ থেকে তিনটি ট্রেনের বগি এবং কয়েকটি বাস ভাড়া করা হয়েছে।’
ফরিদপুর মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘সংগঠনের অন্তত ৪০-৫০ হাজার নেতাকর্মী ঢাকায় যাচ্ছেন। ইতিহাসের স্মরণীয় এই আয়োজনের অংশ হতে আমরা উৎসাহী।’
১০ রুটে স্পেশাল ট্রেন
নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ঢাকায় যাতায়াতের উদ্দেশ্যে বিশেষ ট্রেন ও অতিরিক্ত কোচ বরাদ্দের আবেদন করেছিল বিএনপি। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্পেশাল ট্রেন পরিচালনা এবং নিয়মিত চলাচলকারী একাধিক ট্রেনে অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করা হবে। এ কারণে স্বল্প দূরত্বের রাজবাড়ী কমিউটার (রাজবাড়ী-পোড়াদহ), ঢালারচর এক্সপ্রেস (পাবনা-রাজশাহী) এবং রোহনপুর কমিউটার (রোহনপুর-রাজশাহী) ট্রেনের বৃহস্পতিবারের যাত্রা স্থগিত থাকবে বলে জানিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
এ ছাড়া নিয়মিত চলাচলকারী একাধিক ট্রেনে চাহিদার ভিত্তিতে অতিরিক্ত কোচ সংযোজন করা হবে। স্পেশাল ট্রেন এবং অতিরিক্ত কোচে দলীয় নেতাকর্মীদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে শর্ত হিসেবে নির্বাচনী আচরণবিধিমালা-২০২৫ প্রতিপালন করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক
তারেক রহমানের দেশে ফেরাকে সামনে রেখে বৈঠক করেছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। বৈঠকে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ঐতিহাসিক করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া বৈঠকে শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন বণ্টন নিয়ে নেতারা আলোচনা করেন। এসময় কেউ কেউ তারেক রহমানকে ঢাকা থেকে নির্বাচন করতে অনুরোধ জানান।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সমমনা দল ও জোটের আসন সমঝোতাসহ নিজ দলের বিতর্কিত আর দুর্বল প্রার্থীদের নিয়েও সভায় আলোচনা হয়। সেখানে মিত্র দলগুলোর আসন সমঝোতা অনেকটা সম্পন্ন হয়েছে বলে দলের নেতারা জানান। আর সারা দেশে বিতর্কিত আর দুর্বল প্রার্থীদের বিষয়ে তারেক রহমান দেশে ফেরার পর সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন তারা।
বৈঠকে তারেক রহমানের সংবর্ধনার মঞ্চে কারা উপস্থিত থাকবেন সেটা নিয়েও আলোচনা করেন নেতারা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ছাড়াও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এবং দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা সেখানে থাকবেন। এর বাইরে জুলাই শহীদদের পরিবার ও আহত জুলাইযোদ্ধাদের পরিবারের একজন করে সদস্য থাকবেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য মঙ্গলবার বিকেলে জানান, ঢাকার যেকোনো একটি আসন থেকে তারেক রহমান নির্বাচন করতে পারেন। আগামী শনিবার তিনি ভোটার হবেন এবং তারপর সময়মতো তার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে ঘোষণা দেওয়া হবে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

