শনিবার,

২০ এপ্রিল ২০২৪,

৭ বৈশাখ ১৪৩১

শনিবার,

২০ এপ্রিল ২০২৪,

৭ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

বাঘ গুনতে ৬৬ কোটি, ছাগল গুনতে কত?   

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ১ এপ্রিল ২০২২

Google News
বাঘ গুনতে ৬৬ কোটি, ছাগল গুনতে কত?   

লেখাটি যখন লিখছি তখন গ্রামে এক ধরণের অভাব বিরাজ করছে। কৃষি প্রধান এই দেশে চৈত্র মাসের প্রায় পুরোটাই মানুষের টানাটানি থাকে। ভাতের অভাব এখন আগেও মতো না থাকলেও বৈষয়িক নানা জিনিশের অভাব দেখা দেয়। বিশেষ করে জিনিশপত্রের যে চড়া দাম তাতে সবকিছু ঠিকঠাক থাকে গ্রামে এমন পরিবার এখনো অনেক কম। বৈশাখে নতুন ধান কাটার আগ পর্যন্ত এভাবেই চলতে হয়। এটাই নিয়ম। এর মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ শুমারির খবরটা অনেকের মতো আমাকেও বিস্মিত করেছে। বাঘ গুনতে ৬৬ কোটি টাকার প্রকল্প আমাকে নতুন করে আশান্বিত করেছে। কিন্তু সেই আশার গুড়ে বালি কেননা বাঘ গোনার কাজটি যারা পেয়েছে তাদের সঙ্গে আমার দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। তাই এখান থেকে দু’চার পয়সা পাবারও কোনো সম্ভাবনা নাই। সে কারনেই আফসোস। সেই আফসোস থেকেই এই লেখা। 

সুন্দরবন, আমাদের গর্ব। আর বাঘ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের গর্ব। এই গর্বের হালহকিকত জানতেই উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে মতে তাদের প্রকৃত সংখ্যা জানার অদম্য ইচ্ছা থেকেই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে ৬৬ কোটি টাকা। কাজটি যারা নিষ্ঠার সঙ্গে করবে বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে তারা প্রতিটি বাঘের সংখ্যা নির্ধারণে ৩০ লাখ টাকা ধার্য করেছে। অর্থাৎ এক, দুই, তিন, চার এভাবে একটি করে সংখ্যা বাড়লে মাথাপিছু ৩০ লাখ টাকা করে পাবে তারা। খবরে প্রকাশ- এই কোম্পানিটির সার্ভেয়াররা এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বাস্তবায়নে সুন্দরবনের চল্লিশভাগ এলাকায় ফিজিক্যাল সার্ভে করবে। বাকি ষাট ভাগ এলাকায় তারা প্রবেশ করবে না। সেখানে অনুমানের ভিত্তিতে তারা এ কাজ সমাধা করে সরকারকে প্রতিবেদন দেবে। এই প্রতিবেদনই মূলত বাঘ গণনার যবনিকাপাত করবে। তারা পেয়ে যাবে ৬৬ কোটি টাকা। খবরের বিস্তারিত হলো অক্টোবরে শুরু হতে যাওয়া এ শুমারি ক্যামেরা ফাঁদ পদ্ধতিতে চার মাস ধরে চলবে। এর আগে সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাঘ গণনা করা হয়। সে সময় ১১৪ টি বাঘ শনাক্ত করা হয়। যার মধ্যে পূর্ণ বয়স্ক ৬৩টি, ১৮ টি ১২ থেকে ১৪ মাস বয়সী এবং ৩৩ টি ছিলো শাবক। এবার চাঁদপাই, শরণখোলাসহ মোট চারটি রেঞ্জের ৪০ ভাগ জরিপের আওতায় আনা হবে। বসানো হবে ৩৫০টি ক্যামেরা। বাঘ বিশেষজ্ঞসহ জরিপ দলে থাকবেন ৪০ থেকে ৪৫ জন। মূলত তাদের পেছনেই এতো টাকা ব্যয় হবে। 

এই খবরটি প্রকাশ্যে আসার পর দেশজুড়ে তুমুল হইচই হচ্ছে। অনেকের চোখ কপালে উঠেছে। অনেকে সরকারের এমন প্রকল্পের সমালোচনা করেছেন। সরকার দলীয় কোনো কোনো ব্যক্তি ফেসবুক লাইভে এসে এই কাজের বিরোধিতা করেছেন। সেইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এটি বাতিল করারও দাবি তুলেছেন কেউ কেউ। 

সুন্দরবন পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ বন। সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের দক্ষিণে অবস্থিত এই বন আমাদের রক্ষাকবচ। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে আমাদের উপকূলীয় জনপদকে আগলে রাখে মায়ের মতো। এই বনের প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের ব্রান্ডিং আইটেম, আমাদের জাতীয় পশু। বিশেষ করে আমাদের দেশের ক্রিকেট টিমকে বিশ্বে টিম টাইগার নামেই চিনে। আমরাও এই পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। তাই এই বনে বাঘের সংখ্যা কত সেটি আমাদেরও জানতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সেই ইচ্ছা এতোটা প্রকট নয় যে, এর পেছনে দেশের সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত কোটি কোটি খরচ করাতে হবে।

এর আগে পুকুর কাটা শেখা, আধুনিক প্রযুক্তিতে ধান মাড়াই, মশা মারার পদ্ধতি আবিস্কার, ঠোঙ্গা বানানো প্রশিক্ষণ গ্রহণ, সবজি ক্ষেত্রে কীটনাশক দমন কিংবা এ জাতীয় অনেক কর্ম সম্পাদনে আমলাদের বিদেশ ভ্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এইসব ভ্রমণের ব্যয়ও অনেক বেশি। এমন এমন হাস্যকর বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যয় করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যেগুলোর আসলেই কোনো প্রয়োজন নেই। তবুও এদেশে এইসব সরকারি ভ্রমন বিষয়ক প্রজ্ঞাপণ পাশ হয়েছে। আমলারা গিয়ে বিদেশ ঘুরে এসেছেন। কেউবা সরকারি খরচের সঙ্গে কিছুটা যোগ করে স্ত্রী-কন্যা নিয়েও সেসব ট্যুর সম্পন্ন করেছেন। সেসব ট্যুর নিয়েও বেশ প্রতিক্রিয়া হয়। সামাজিক মাধ্যমতো বটেই মূল ধারার গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাতে কি- যারা ‘দক্ষতা’ বাড়াতে চায় তাদেরতো আর দমিয়ে রাখা যায় না। তাই বিদেশ ট্যুর চলতেই থাকে। পাবলিকের পকেটের টাকায় তাদের আরাম আয়েশের এই প্রকল্প তাই দিন দিন বাড়ছেই। 

আমাদের দেশে দিনকে দিন বনাঞ্চল কমছে। পাহাড় কাটা হচ্ছে দেদারছে। নদী থেকে শুরু করে সমুদ্রও দখল হচ্ছে। সেই সঙ্গে উজাড় হয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন। বাঘের বদলে সুন্দরবন এখন ডাকাদের অভয়ারণ্য। এই ডাকাত যে তথাকথিত দস্যু তাই নয়। যারা রাষ্ট্রীয় টাকায় সেখানে রক্ষক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন তারাও। মূলত তাদের সহায়তায়ই উজাড় হচ্ছে বনের দামি গাছ, পশু-পাখি থেকে সব ধরণের সম্পদ। এই ধংস রোধ না করে বাঘ গণনা করে আসলে কি লাভ সেটি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার বোধগম্য নয়।  আমার বিশ্বাস কোটি কোটি লোক রয়েছে যাদের মনেও এমন প্রশ্ন রয়েছে।   

দেশীয় অর্থে পদ্ম সেতুসহ নানা উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছে। একটি ভোটারবিহীন সরকারের কাছে দৃশ্যমান উন্নয়নের কদর অনেক। বড় বড় স্থাপণা না দেখালে মানুষকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে যে এই সরকার সত্যিই জনবান্ধব। তাদের মন থেকে গণতন্ত্রণ লুটের ছবি সরাতে হলে এইসব ব্রিজ-ভবনের ছবি বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। তবেই তারা অতীতের ভোট ডাকাতি কিংবা গুম-খুনের সচিত্র প্রতিবেদন ভুলে যাবে। এই কায়দায় চলছে আমাদের দেশের বর্তমান উন্নয়নযজ্ঞ। 

নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বি হওয়ার পর সরকার এক কোটি পরিবারকে স্বল্পমূল্যের কার্ড দিয়েছে। ইতোমধ্যে এই কার্ড যারা পাচ্ছেন তাদের পরিচয় সামনে আসতে শুরু করেছে। তাদের অধিকাংশই সরকারী দলের লোক। অনেক নেতা-যারা ইতোমধ্যে অবৈধ উপায়ে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন তারাও এই কার্ড পেয়ে ধন্য হয়েছেন। অথচ গ্রামের এই দুরবস্থার চিত্র যাদের নিরপেক্ষ চোখ রয়েছে কেবল তারাই দেখছেন। কত মধ্যবিত্ত পরিবার এই দুই বছরে নি¤œবিত্তে এসে ঠেকেছে তার হিসাব কে রাখে। অথচ সুন্দরবনে বাঘ কতটি রয়েছে, আগের তুলনায় বেড়েছে না কমেছে সেই হিসাব কষতে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে। এইসব বরাদ্দ যারা দেয় তারা এক প্রকার ছাগল। আমি শতভাগ নিশ্চিত সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বাড়–ক বা নাই বাড়–ক এইসব ছাগলের সংখ্যা দেশে ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে। সরকারের প্রতিটি সেক্টরে এইসব ছাগলের ছড়াছড়ি। একজন সচেতন মানুষ হিসেবে তাদের সংখ্যাটা আপনারও জানা থাকা প্রয়োজন। তাই বাঘ গুনতে যদি ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় তবে এইসব ছাগল গুনতে কত টাকা প্রয়োজন? সরকারের কোন দপ্তরে গেলে সেই হিসাব পাওয়া যাবে তথ্যটি জানা দরকার। 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। 
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের