ইতিহাসের ভয়াবহতম বন্যায় কবলিত সিলেট। জনপদের লাখ লাখ লোক মানবেতর জীবন যাপন করছে। যদিও রাজধানী ঢাকায় বসে সিলেটবাসীর সেই দু:খ বোঝার উপায় নেই। না মূল ধারার গণমাধ্যম না সামাজিক মাধ্যম। এমনকী চায়ের টেবিলেও নেই সিলেটীদের নিয়ে তেমন কোনো চর্চা। এক পদ্মা সেতুই সমস্ত যায়গা দখল করে রেখেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনকে সামনে রেখে দেশের কোনো খারাপ সংবাদই যেন আর সেভাবে জনগণের দৃষ্টিতে খারাপ মনে হচ্ছে না। যদিও এর মধ্যে সিলেটের সাংবাদিক মইনুদ্দীন মঞ্জু এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা কিছুটা যায়গা করে নিয়েছে।
সাংবাদিক মঞ্জু সিলেটের পরিচিত সাংবাদিকদের মধ্যে অন্যতম। তার সততা-নিষ্ঠা কিংবা পেশাদারিত্ব নিয়ে কোনো নেতিবাচক কথা কানে আসেনি। সোমবার সিলেট সরকারী আলীয়া মাদরাসা মাঠে ছাত্রদল-ছাত্রলীগ সংঘর্ষের সময় পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের বেদম প্রহারের শিকার হয়েছেন। ঘটনার ভিডিও ফুটেজে ছাত্রলীগের ওইসব হামলাকারীর স্পস্ট পরিচয় থাকার পরও এখন পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেছে বলে খবর আসেনি। ঠিক একইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছে ছাত্রদল। হামলায় এক ছাত্রদল নেত্রীকে রাস্তায় ফেলে ভয়ানকভাবে পেটানোর ফুটেজ এখন ঘুরছে ফেসবুক দুনিয়ায়।
দীর্ঘদিন ধরে দেশের মাধ্যমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক থেকে প্রাইভেট সবখানে ক্ষমতাশীল রাজনীতির মূল হাতিয়ার ছাত্রলীগ একক রাজত্ব করে আসছে। এসময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে খুনসহ অসংখ্য হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। গত কয়েক বছর বিরোধী দলের কোনো নেতাকর্মীকে না পেয়ে তাদের এই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যের প্রভাব পড়ে নিজ দলের গ্রুপ ভিত্তিক রাজনীতির ওপর। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে একে অন্যের রক্তে হাত রাঙিয়েছে। তবে সম্প্রতি ছাত্রদলের নতুন কমিটি হওয়ার পর এই প্রথম রাজনীতির মাঠে দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে বড় ধরণের কোনো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি দেখেছি। শুরু থেকেই সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সক্রিয় রাজনীতি করার সুযোগ হয়নি। সুযোগ থাকলে নিশ্চয়ই ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম না। কেননা যতটুকু দেখেছি তাদের কাছ থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপকৃত হয়নি। নির্যাতন-নীপিড়ন, ভাংচুর আর অযথাই ত্রাস সৃষ্টি করতে দেখেছি এই দলটির নেতাকর্মীদের। তার মুখে জয়বাংলা স্লোগান আর মুজিবের আদর্শের কথা বললেও কাজে-কর্মে তার প্রতিফলন দেখিনি। অন্তত গত দুই দশকে তাদের কোনো কর্মসূচী সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ছিলো বলে প্রমান নেই। উপরন্তু তারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, পরিবহনে হাফভাড়ার আন্দোলনের মতো জাতীয় ইস্যুতে সাধরণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্মম নির্যাতন করেছে। এইসব আন্দোলন প্রতিরোধ করতে গিয়েই তাদের ভেতর থেকে গড়ে উঠেছে হাতুড়ি লীগ, হেলমেট লীগ, টোকাই লীগ ধরণের কিছু পেটোয়া বাহিনী। এটি তাদের সামগ্রিক অর্জনকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের কুৎসিত পরিচয়টিই তুলে ধরেছে।
ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার পর থেকে তারা সারা দেশে নতুন করে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করছে। মূল দল বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় গত কয়েকটি কমিটি সেভাবে সারাদেশের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে পারেনি। বিপরীতে এই আগের কমিটির বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মেরও অভিযোগ রয়েছে। সে তুলনায় এবারের কমিটি অনেকটাই সুসংগঠিত ও সাংগঠনিক বলে অনেকেই মনে করেন। ছাত্রলীগের অনেককেই বিষয়টিতে একমত পোষণ করতে দেখেছি। স্বাভাবিক কারনেই এই কমিটি সারাদেশে তাদের নেতাকর্মীদের জাগিয়ে তুলেতে চাইবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা সারাদেশে একটা সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে আসতে চাইবে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রস্থল সে কারনে শুরু থেকেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক তৎপরতা শুরু করে। প্রায় প্রতিদিনই মিছিল-শোডাউন করে চলেছে নতুন এ কমিটি। আর তাতেই গাত্রোদাহ শুরু হয় ছাত্রলীগে। কেননা দীর্ঘদিন একচেটিয়া আধিপত্য থাকা ক্যাম্পাসে তারা ছাত্রদলকে ভাগ বসাতে দিতে চায় না। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কোনো একক সংগঠনের ইজারা নেওয়া নয়। এখানে মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চার যেমন যায়গা তেমনি উন্মুক্ত রাজনৈতিক চর্চারও যায়গা। তাই এখানে সব দলের রাজনীতির সুযোগ থাকবে।
আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্দেশিত হয় মূল রাজনৈতিক দলের ইশারায়। দলীয় প্রধানের নির্দেশ কিংবা আদেশই তাদের কাছে সব। এর বাইরে আবার রয়েছে বিভিন্ন সিনিয়র নেতার লবি মেনটেইন। প্রত্যেকটি ছাত্র সংগঠনের আলাদা-আলাদা গঠনতন্ত্র থাকলেও তা কখনোই অনুসরণ করা হয় না। যে কারনে ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের কল্যাণের জন্য না হয়ে সেটি এখন তাদের অধিকার হরণের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এক সময় বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে ছাত্র সংগঠনগুলোর যে মিছিল-শোডাউন ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বর্ধন করতো এখন তা যেন পরিণত হয়েছে সৌন্দর্য বিনষ্টকারী হিসেবে। ক্যাম্পাসের প্যাম্পাসে রূপ নিয়েছে এই দলীয় লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি। যা আমাদের জাতীয় রাজনীতির মলমুত্রকে সাময়িক আটকে রেখে কেবল দুর্গন্ধকেই গাড় করছে না ভেতরে ভেতরে ক্যান্সারের জীবানু ছড়াচ্ছে যেন।
ছাত্রলীগের দুবৃত্তদের হাতে প্রকাশে রাস্তায় এর আগেও মেয়েরা হামলার শিকার হয়েছে। এর আগে নিজ দলের মেয়েরাও পিটুনি খেয়েছে তাদের হাতে। এর আগেও এসব কাজের সমালোচনা হয়েছে কঠোর। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। শোধরায়নি তারা। রাজনীতি যে শিষ্টাচার আর পরমত সহিষ্ণুতার যায়গা সেটি তারা বুঝেনি, হয়তো বুঝতে চায়ওনি।
আমাদের দেশে একটি গোষ্ঠী রয়েছে। তারা কোনো নারীর প্রতি অন্যায়-অমানবিক আচরণ ঘটলে ঝাপিয়ে পড়ে। আমরা তাদের নারীবাদী চক্র বলে সহজে তাদের চিনে থাকি। এর আগে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যে তারা কোনো একটি ইস্যুও টিস্যুকে পেচিয়ে পেচিয়ে দড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। তিলকে তাল আর দুধকে ঘোল বানাতেও তারা পারঙ্গম। কিন্তু কিছু বিশেষ বিশেষ স্থান, পরিস্থিতি, পরিবেশ দেখে তারা এইসব পারঙ্গমতা প্রকাশ করেন। তেমনি একটি স্থান হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার শিকার ছাত্রদল নেতাদের বেলায়। কেননা এই চক্রটি এইসব যায়গায় বরাবরের মতোই নীরব। তাদের গুরু মাতাদের এইসব ইস্যুতে কোনো নির্দেশনা থাকে না। তাই তাদের কোনো ছানাপোনাদেরও এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদী কথা থাকে না। না রাজপথে না সামাজিক মাধ্যমে। অথচ অরাজনৈতিক ওই প্লাটফর্মের ভূমিকা হওয়ার কথা ছিলো সবার জন্য সমান। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য সেটি হয়নি। অতিরাজনৈতিক এই দেশে এই ধরণের নীতিই আসলে এক ধরণের পতিতাবৃত্তির মতো। এই রাজনৈতিক পতিতাবৃত্তির যে ধারা আমাদের দেশে দিন দিন প্রকট হচ্ছে এর ভবিষ্যত নিশ্চয়ই ভালো নয়। আমরা মুখে যতই আইন, ন্যায় বিচার, মৌল-মানবাধিকার কিংবা সহনশীল সমাজের কথা বলিনা কেন এই ধরণের রাজনৈতিক পতিতাবৃত্তির মানসিকতা যদি ত্যাগ করতে না পারি তবে মুখের এইসব বক্তব্য কেবল মুখেই থেকে যাবে। সেগুলো আমাদের কারোরই উপকারে আসবে না। না সমাজের, না রাষ্ট্রের।
লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী
রেডিওটুডে নিউজ/এমএস