শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪,

১৫ চৈত্র ১৪৩০

শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪,

১৫ চৈত্র ১৪৩০

Radio Today News

ডালিয়াদের অসহায়ত্ব ও পুরুষযন্ত্রের সহায়নীতি

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ৬ মে ২০২২

আপডেট: ২১:৫৫, ৬ মে ২০২২

Google News
ডালিয়াদের অসহায়ত্ব ও পুরুষযন্ত্রের সহায়নীতি

রাজধানীর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনা এখন পুরনো হয়ে গিয়েছে। ঈদ উৎসবে ঢাকা পড়ে গেছে ওই সংঘর্ষে নিহত দোকান কর্মী মুরসালিন ও কুরিয়ার কর্মী নাহিদের কথাও। মানুষ আসলে এমনই। নতুনকে নিয়েই তার দিন শুরু হয়। মস্তিস্কের নিউরণে নতুন কিছু আগমন মানেই পুরনো বিস্মৃত হওয়া। এখানে দোষের কিছু নেই। তবে এই বিস্মৃতির মধ্যেই নতুন করে আলোচনায় এসেছেন মৃত নাহিদের স্ত্রী ডালিয়া আকতার। আর আলোচনার প্রসঙ্গ একটু ভিন্ন। তাকে নিয়ে এক চরম নিন্দনীয় চর্চা হচ্ছে সহায়তার নামে। 

প্রিয় পাঠক, নাহিদ নিতান্ত গরীব ছেলে। সবে মাত্র যৌবনে পা রাখা নাহিদ বিয়ে করেছিলো ভালোবেসে। যেই বয়সে ঢাকা কলেজের ছেলেরা বাড়ি থেকে টাকা এনে পড়ে। অথবা কেউ কেউ টিউশনি করে নিজেকে চালায় সেই বয়সে নাহিদ কুরিয়ারে চাকরি করে স্ত্রীসহ বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিয়েছিলো। ভালোবাসার শক্তিকে পুজি করে সাহস নিয়ে নেমেছিলো জীবনযুদ্ধে। কিন্তু হেলমেট বাহিনী তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। শেষ হয়ে যায় তার জীবন সংগ্রাম। সেই থেকে প্রসঙ্গক্রমে আলোচনায় আসে সদ্য বিধাব কৈশর পেরোনো স্ত্রী ডালিয়া। 

পরিবারের এই অসহায় অবস্থায় অনেক গণমাধ্যমই তাদের প্রতিবেদনে মানবিক বিষয়টিকে সামনে আনেন। সহায়তার আহবান জানানো হয় অনেক ভিডিওর মাধ্যমে। সেই ভিডিওতে দেওয়া হয় ডালিয়ার মুঠো ফোন নম্বর। ব্যস তাতেই বিপত্তির শুরু। এই বিপত্তি একটি অল্প শিক্ষিত মেয়ের ক্ষেত্রে সামলানো বেশ কঠিন কাজ। বিশেষ করে যে পরিবারে পুরুষ বলতে নাহিদই ছিলো সক্ষম সেখানে এই ধরণের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি কে সামলায়? 
এর মধ্যে অনেকেই সহায়তা করেছেন নাহিদের পরিবারকে। অনেক ব্যাক্তি প্রতিষ্ঠান পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে এর মধ্যে খবর হলো- কেউ কেউ সহায়তার নাম করে মুঠো ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে চাইছেন ডালিয়ার সঙ্গে। কেউ কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছেন। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে কেউ আবার বাসায়ও চলে আসছেন হুটহাট। এই যে নতুন কিসিমের সহায়তা তা নিয়ে বেশ সমস্যায়ই পড়েছেন ডালিয়া। 

সম্প্রতি অনলাইন সংবাদ মাধ্যম জাগো নিউজ একটি ভিডিও স্টোরি করেছে ডালিয়াকে নিয়ে। ভিডিওর প্রতিবেদক আমার পরিচিত। প্রতিবেদক ডালিয়ার সঙ্গে কথা বলে তাকে সহায়তার নামে এই ধরণের উত্যক্তের বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। সেই সঙ্গে ডালিয়া যে এইসব কারনে চরমভাবে লজ্জিত ও অপমানিত বোধ করছেন সেটিও ফুটে উঠেছে। কথা বলার এক পর্যায়ে মেয়েটি কেঁদে ফেলেছে। স্বামীর মৃত্যু শোকে এখনো কাতর যে মেয়ে তার কাছে এমন প্রস্তাব যে পুরুষরা দেন তাদের বিবেক-বুদ্ধি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ডালিয়া। 

আমাদের দেশে নারী নির্যাতন কিংবা উত্যক্ত অথবা ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলোকে নারীবাদিরা সব সময়ই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুপ্রভাব হিসেবে দাবি করে আসছেন। অর্থাৎ এ ধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পেছনে পুরুষতন্ত্রের প্রচলিত খাসলতকেই দায়ী করেন তারা। তাদের এই ধারণা অনেকাংশেই ঠিক। তাই তাদের প্রতিবাদের ভাষা কিংবা ধরণ নিয়ে আপত্তি থাকলেও দাবির যথার্থতা নিয়ে জোরালো কোনো প্রতিবাদে কখনো যাই না। এমনও হয়েছে আমার অফিসের কোনো সহকর্মীই নারীনেত্রী। তার সঙ্গে কোনো কোনো ইস্যুতে তিক্ত তর্কও হয়েছে। কিন্তু কখনো এই অভিযোগটি খন্ডনের চেষ্টা করিনি যে নারী প্রতি সহিংসতার পেছনে পুরুষতান্ত্রিকতার দায়ই বেশি। বরং কিছু কিছু ঘটনা তাদের এই যুক্তিকে আরো প্রকট করেছে। যার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ের ডালিয়া ইস্যুও আনা যায়। 

ডালিয়া মেয়েটার শিক্ষাগত যোগ্যতা কি আমি জানিনা। তবে এই বয়সী একটা মেয়ের খুব বেশিদূর যাওয়া যে সম্ভব হয়নি সেটিও অনুমেয়। তার কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে নিতান্তই সাধারণ ঘরের। লেখাপড়াও খুব হয়তো যতসামান্য। এমন একটা মেয়েকে বিয়ের জন্য যারা প্রস্তাব দিচ্ছেন, যারা তার বাসায় গিয়ে বসে থাকছেন তাদের যোগ্যতা কি সেটিও আমার জানা নেই। তবে তারা যে মানসিকভাবে খুবই নীচু সেটি বলতে দ্বিধা নেই। সহায়তার নাম করে একটি মেয়ের অসহায়ত্বকে যারা এভাবে ঘোঁচাতে চান তাদের চিন্তার দীনতা দেখে আমি লজ্জিত হই। পুরুষ হিসেবে নিজেকে খুব অদ্ভুত প্রাণি বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে ভাবি এই যে চিন্তার আকাল, এই যে মানসিকতার অবক্ষয় এটি কি আমাদের চিরকালীন স্বভাব। নাকি সময় ভেদে এর হেরফের হয়। যদি বিষয়টি এমন হয় যে, যে সব পুরুষ ডালিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তারা মনের অজান্তেই এই ধরণের চিন্তা পোষণ করে। কিংবা এমন ধারণা তারা বংশ পরম্পরায় বহন করে আসছে। যেই পরম্পরা হয়তো আমার ভেতরেও থাকতে পারে। এমন চিন্তা হয়তো আমার ভেতরেও রয়েছে যদিও তা সুপ্ত। যদি থাকে তবে সেটি ভয়ঙ্কর। কেননা নারীর অসহায়ত্বকে পুঁজি করে পুরুষের পৌরুষের যে ক্রমাগত বিকাশ সেখানে মানবিক মূল্যবোধের বালাই নেই। লালসাই এখানে মূখ্য। কেউ সেটাকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করে আবার কেউ প্রকাশের ক্ষেত্রে নগ্ন হয়ে যায়। ডালিয়ার ক্ষেত্রে এইসব পুরুষরা নগ্নভাবেই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যে কারনে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

যেসব পুরুষ ডালিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন তারা নিশ্চয়ই আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখেন না। কিংবা দেখলেও তাদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি প্রকট। তারা চাইলে অনায়াসে অন্য যে কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারে। চাইলে যে কোনো মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারে তারা। সেটি না করে একটা বিধবার জন্য তাদের এই সহানুভূতি প্রকাশ একটু নয় বেশ বাড়াবাড়িই বটে। ডালিয়া-নাহিদের বিয়েটি ভালোবাসার ছিলো। তাই এখানে আবেগের বিষয়টি প্রবলভাবে জড়িত। স্বামীর মৃত্যুর ১০ দিন না যেতেই এই ধরণের প্রস্তাব নি:সন্দেহে ডালিয়াকে হতবাক ও ক্ষুব্ধ করেছে। যেটি ডালিয়ার যায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলেও হয়তো হতো। 

ডালিয়ার বাবা-মা রয়েছে। শ্বশুর- শাশুড়ি রয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যরাও আছে। নিশ্চয়ই তারা ভবিষ্যতে এমন একটি সিদ্ধান্তে আসবেন যাতে ডালিয়াকে সারাজীবন নি:সঙ্গ থাকতে না হয়। সংসার জীবন শুরু না করতেই যা ভেঙ্গে গেছে সেখানে আঁকড়ে থাকার মতো যথেষ্ট অনুসঙ্গ নেই এটি বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে মেনে হয়তো ডালিয়াও একদিন নতুন কোনো সিদ্ধান্তের উপনীত হতে বাধ্য হবেন। সেটি সে সময়ের ব্যাপার। তাই বলে এখনই যারা তাকে এ ধরণের প্রস্তাব দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিচ্ছেন তারা নি:সন্দেহে খারাপ কাজ করছেন। এতে সহায়তার নামে পুরুষযন্ত্রের আদিম চরিত্রই প্রকাশ পেয়েছে। যেই চরিত্র ঢাকতে আমরা যুদ্ধ করি। যে চরিত্রের কালিমা ঢাকতে আমরা সভ্যতাকে নতুন মোড়কে সাজাই। আবার কখনো কখনো যুক্তিতর্ক খেলায় মেতে উঠি নারীবাদের সাথে।

লেখক: সাংবাদিক, কথাশিল্পী।


   
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের