শুক্রবার,

২৬ এপ্রিল ২০২৪,

১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শুক্রবার,

২৬ এপ্রিল ২০২৪,

১৩ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

গোড়া কাটিয়া আগায় পানি ঢালা কম্ম   

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ৪ জুন ২০২২

Google News
গোড়া কাটিয়া আগায় পানি ঢালা কম্ম   

রাজধানীর খিলগাঁও-তালতলা এলাকা এখন খাওয়া-দাওয়ার জন্য একটি প্রসিদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন যে কি পরিমাণ লোক এখানকার হোটেল-রেস্তোরাঁ গুলোয় খেতে আসে তা অনুমান করাও দু:সাধ্য। সেদিন সন্ধ্যার পরে খেতে খেতে এ সপ্তাহের লেখার বিষয় নিয়ে কথা উঠলো। শ্রদ্ধেয় মঈন উদ্দীন খান আমাকে লেখার একটি আইডিয়া দিলেন। দুনিয়া কাঁপানো টপিক। বলতে পারেন এই মুহূর্তে দেশের নাম্বারওয়ান টপিক। যাকে নিয়ে সরকার কিংবা সাধারণ মানুষ সবাই ব্যস্ত। সেই পদ্মা সেতুকে টপিক বানিয়ে লিখতে বললেন। কিন্তু আমার মনের মধ্যে অন্য কিছু খেলছে তারও আগে থেকে। তাইতো আপাতত এ সপ্তাহেও বরাবরের মতো নিজের পছন্দের টপিক বেছে নিলাম। পদ্মা সেতু নিয়ে সবাই লিখছে। এতো এতো নামি-দামি মানুষের লেখার ভীড়ে কেউ হয়তো খুঁজবেওনা আমার লেখা। তাই আমি একটি ঘুরে আসি রাজধানীর বাইরে থেকে। দেখে আসি নরসিংদী রেলস্টেশনের সেই ‘ছোটো পোশাকের নারী উত্যক্ত’র ঘটনাটি। জানার চেষ্টা করি বর্তমান হালহকিকত। 

ইতোমধ্যে বিষয়টি সবাই অবগত। পশ্চিমা ধাঁচের ছোটো পোশাকে ঢাকার বাইরের একটি রেলস্টেশনে গিয়ে কোনো এক তরুনী হেনস্তার শিকার হয়েছেন। এই ঘটনায় ষাটোর্ধ এক নারীসহ কয়েকজনকে আটক করেছে। কয়েকজনের প্রসঙ্গ বাঁদ দিয়ে আমি কেবল ওই নারীর আলোচনায় যেতে চাই। ওই নারী পেশায় একজন ঘটক। ঘটনার দিন ট্রেনে করে ঢাকায় আসতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু রেলস্টেশনে ওই ছোটো পোশাকের মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত কেউ কেউ যখন প্রায় উত্যক্ত করছিলো তখন ওই ভদ্র মহিলা নাকি তরুনিটিকে বলেছিলেন, ‘এখানে অনেকেই বিষয়টি ভালোভাবে দেখছে না। তুমি ওড়না দিয়ে তোমার পেটটা একটু ঢাকো’। এ ধরণের কিছু বলে মেয়েটিকে একটি সেফ জোনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ওই বয়স্ক মহিলা। অথচ ঘটনার মারপ্যাচে পড়ে পরে ওই মহিলাই হয়ে যান ভিক্টিম। তাকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। অত্যন্ত দরিদ্র ওই মহিলার স্বামী নেই। ঘরে একটি প্রতিবন্ধী মেয়ে রয়েছে। ঘটকালি করেই তাদের সংসার চলে। এখন জানিনা কেমন আছেন সেই ঘটক, কেমন কিংবা কোথায় কার আশ্রয়ে রয়েছে তার সেই প্রতিবন্ধী মেয়েটি। 

সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো ভিডিওতে দেখা যায় মেয়েটি যে ধরণের পোশাক পরেছে সেটি রাজধানীর কিছু কিছু যায়গায় চোখে পড়ে। তাও পুরো রাজধানীর সবখানে নয়। কেননা আমাদের দেশের মানুষ এই ধরণের পোশাক দেখে অভ্যস্ত নন। খুব রাজধানীতে এই ধরণের পোশাক পরিহিতা মেয়েদের দিকে আড়চোখে অনেকে তাকালেও কেউ প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস রাখে না হয়তো। কিন্তু ঢাকার বাইরে এই ধরণের পোশাক পরিহিতাদের নিশ্চয়ই সেই ঝুঁকিটা থেকে যায়। হয়েছেও তাই। মেয়েটিও ওইসব লোকদের কুরুচিপূর্ণ বাক্যবানে জর্জরিত হয়েছে। আর আইনজীবীর ভাষ্য অনুযায়ি তার মক্কেল ওই নারী মেয়েটিকে নিজের মেয়ে মনে করে উপদেশ কিংবা পরামর্শ দিতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছেন। 

আমরা সে সমাজে বসবাস করি সেই সমাজের একটি নিজস্ব মূল্যবোধ রয়েছে। যেটি স্থান-কাল- কিংবা পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন। তাই মেয়েটি যে স্থানে এই ধরণের পোশাক পরে গিয়েছে সেটি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। তার পরিবার কিংবা সে যে সোসাইটি বিলং করে সেখানে এই ধরণের পোশাক কোনো ব্যাপার না হলেও নরসিংদী রেলস্টেশনে সেটি নিশ্চয়ই ব্যাপার। তাইতো মেয়েটির পোশাক নির্বাচন যাই হোক স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতা রয়েছে। কেননা আপনি যে সমাজে যাচ্ছেন সেটি মাথায় রেখেই আপনাকে আচরণ করতে হবে। সেটি মুখ কিংবা শরীর দুই যায়গার জন্যই প্রযোজ্য। সেটিই বরং স্মার্টনেস, সেটিই রুচি কিংবা ব্যক্তিত্ব। 

দুপুর থেকেই ফেসবুকে বাচ্চাদের ছবি দেখছি। কেউ কেউ পোস্টার-ব্যানারেও স্থান পেয়ে ফেসবুকে ঘুরছে। কোনো কোনো বাবা তার ছেলে-মেয়েকে অভিনন্দন জানিয়ে এসব স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচন নিয়ে এইসব প্রচার-প্রচারণা। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের দেশব্যাপী এক উদ্যোগ এটি। উদ্দেশ্য শিশুদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মানসিকতা ও নেতৃত্বের বিকাশ। তাইতো প্রতি বছর বেশ ঘটা করে এই নির্বাচন আয়োজন করে আসছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আপত দৃষ্টিতে হয়তো অনেকেই এর মধ্যে ইতিবাচক কিছু দেখছেন। সেটি দেখতে পেলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল। 

আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সিলেবাসে গত ক’বছরে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগে আমরা যেখানে কেবল ধর্ম বই পড়তাম এখন ছেলে-মেয়েরা তার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষারও পাঠ নিচ্ছে। তার মানে কেবল ধর্ম শিশুদের নৈতিক বানাতে পারছে না বলেই সরকার এই বিষয়টিতে বাড়তি নজর দিয়েছে। পাঠ্যবই তাদের মূল্যবোধও গড়ে দিচ্ছে। আবার যেই শিশু এখনো বিছানায় পেশাব করে কিংবা এখনো মা খাবার মুখে তুলে না দিলে খেতে চায় না তাকেও দেয়া হচ্ছে গণতন্ত্রের হাতে খড়ি। আগামী প্রজন্ম যাতে গণতন্ত্র মনস্ক কিংবা রাজনীতি সচেতন হয়ে সু-নাগরিক হতে পারে সে জন্যই নাকি এই ভোটের হাতে খড়ি। 

আমাদের দেশের বিশেষ বাহিনী র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী একটি আলোচিত বিষয়। বিষয়টি নিয়ে সরকার রীতিমত চাপে রয়েছে। গুম ও বিচারবহির্ভুত হত্যা যে বাহিনী নিত্য দিনের কাজ ছিলো এখন তারাও এসব কাজ থেকে বিরত রয়েছে। ইমেজ ফেরাতে নানামুখী কাজ করছে তারা। তাইতো কথিত ‘নারী হেনস্তা’র বিষয়টিতে তার ঝাপিয়ে পড়েছে। কথিত অভিযুক্ত নারীকে যে কায়দায় তারা মিডিয়ার সামনে উপস্থিত করেছে তাতে মনে হয়েছে কোনো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কিংবা আন্তর্জাতিক মানের জঙ্গী। জানিনা এই ধরণের অপরেশনের মাধ্যমে তাদের হৃত সুনাম কতখানি ফিরবে। তবে এটি ঠিক যে ওই মহিলাকে নির্দোষ দাবি করে নরসিংদীতে এখন হাজার হাজার মানুষ মিছিল করছে। রাস্তায় নানা ধরণের আন্দোলনে র‌্যাবের এমন আচরণের নিন্দা জানানো হয়েছে। ষাটোর্ধ বোরকাপরা ওই নারীর পক্ষ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও রীতিমত প্রতিবাদ চলছে। 

আমাদের দেশের বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে একটি নির্বাচন বিনাভোটের এবং অন্যটি রাতের ভোটের হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। সেখানে এইসব দুগ্ধপোষ্য শিশুদের ঘটাকরে গণতান্ত্রিক চর্চার হাতেখড়ি কতখানি কাজের কাজ আমার বুঝে আসে না। বুঝি না রাষ্ট্রীয়ভাবে নীতি-নৈতিকতা কিংবা রুচি-মূল্যবোধের অবক্ষয়কে প্রমোট করার মিশন তরান্বিত করে পাঠ্য বইয়ে নৈতিক শিক্ষার ছবক সংযোজনের মাজেজার বিষয়টিও। আবার এটাও বুঝতে পারি না যেসব গুরুতর অপরাধের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কথিত ওই নারী উত্যক্তকারী নারীকে ধরে তার কতটুকু উদ্ধার করতে পারবে আমাদের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। যদি এই তিনটি বিষয়ই ইতিবাচক হয় তবে নিশ্চয়ই সেটি আমাদের সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। 
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের