শুক্রবার,

২৬ এপ্রিল ২০২৪,

১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শুক্রবার,

২৬ এপ্রিল ২০২৪,

১৩ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

মধ্যবিত্তের পদ্মা সেতু প্রেশার

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ১৯:০৪, ১০ জুন ২০২২

আপডেট: ১৯:১৪, ১০ জুন ২০২২

Google News
মধ্যবিত্তের পদ্মা সেতু প্রেশার

বুুধবার জাতীয় সংসদের আলোচনায় বাজেটের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে পদ্মাসেতু ইস্যু। জীবনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়েছেন এমন একজনের জ্বালাময়ী ভাষণ শুনছিলাম। উনি ভোট ডাকাত। রাতের অন্ধকারে ব্যালটবাক্স ভরা নেতা। স্বাভাবিকভাবেই তার বক্তব্যে বারুদ ঝরছিলো। এমনিতে দীর্ঘদিন ধরেই সংসদের কোনো অধিবেশন কিংবা কারো বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শোনা হয় না। কেমন যেন বিরক্ত লাগে। যারা চুরি-ডাকাতি করে পবিত্র ওই যায়গায় গিয়েছে তাদের কাছ থেকে নীতি-নৈতিকতার কথা শুনতে ভালো লাগে না। তবে খিস্তি-খেউড় আলাদা বিষয়। এটি কপচাতে সংসদের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো স্থানে বসেই করা যায়। যদিও সংসদে এ ধরণের কর্মকা- শোভনীয় নয়। 

মহান এ নেতার বক্তব্যের একটি যায়গায় শুনলাম পদ্মা সেতুর বিরোধীতাকারী ড. মুহম্মদ ইউনুসকে জলন্ত আলকাতরার মধ্যে ডুবিয়ে মারলেও নাকি তার কৃত অপরাধের মার্জনা হবার নয়। হয়তো বিষয়টি তেমনই। তা না হলে জাতীয় সংসদের মতো রেকর্ডেড যায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি বলতেন না। এ ধরণের কথা বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়েও বলেছেন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই দুই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে পদ্মায় ডুবিয়ে মারার কথা বলেছেন। যদিও তার সেই বলা হাসি-কৌতুকের ছলে না সত্যি সত্যিই সেটি জানা যায়নি। তার সেই বক্তব্য নিয়ে রাজনীতিতে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তাই নতুন করে কোনো আলোচনা কিংবা সমালোচনায় যেতে চাই না। আমি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাই এখানে এই শ্রেণিকে নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। 

আজ থেকে অন্তত বছর চারেক আগে রাজধানীর বাবু বাজারে স্কুলের বেশকিছু খাতাপত্রের কাজে যেতাম। বছরের মাঝামাঝি এইসব কাজ শুরু করতে হয়। বিগত বছরের চেয়ে সে বছর কাগজের দাম বেশি হওয়ায় বিষয়টি প্রেস মালিকের কাছে জানতে চাইলাম। তিনি জানালেন তাদের এসোসিয়েশন থেকে একটি বড় অংকের টাকা পদ্মাসেতু প্রকল্পের জন্য নাকি দিতে হয়েছে। তাই খাতা-পত্রের রেট এবার বেশি পড়বে। সত্যি সত্যি সেবার অন্যবারের চেয়ে পারপিস খাতায় ১ থেকে ২ টাকা বেশি খরচ হয়। আমরাও স্কুলে খাতার মূল্য সামান্য বাড়িয়ে দেই। এভাবে দেশীয় বাজারের সবগুলো যায়গা থেকেই পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছে সরকার। কেননা আমরা সবাই জানি ৩০ হাজার কোটি টাকার এই মেগা প্রকল্পের সম্পূর্ণ অর্থ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তাইতো দাম বেড়েছে সুই থেকে শুরু করে টিনের, চাল থেকে শুরু করে ভীমের। দেশের এমন কোনো পণ্য নেই যাতে এই সেতুর স্পর্শ লাগেনি। তবে সেটি যতোটা না যৌক্তিক তার চেয়ে বেশি ভৌতিক। কেননা আমাদের দেশে সাচ্চা দেশপ্রেমিক ব্যবসায়িক সমাজ এই ইস্যুটিকে একেবারে লুফে নিয়েছে। তাই প্রকৃতপক্ষে যতটুকু প্রভাব পড়ার কথা ছিলো তার চেয়ে বেশিই পড়েছে। 

আর হাতে গোনা ক’টা দিন। ২৫ জুন এই সেতুর উদ্বোধন হবে। দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পের উদ্বোধন উপলক্ষ্যে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বনিম্ম স্তরেও চলছে উৎসব প্রস্তুতি। মিডিয়ার খবরের সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে এই ইস্যু। এমনকী সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপণা কম নয়। 

ইতোমধ্যে সেতুর টোল হার ঘোষণা করা হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে করা এই সেতু পর হতে কেন এতো বেশি টোল দিতে হবে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও সরকার দলীয় অনেকেই এই টোলহারকে যৌক্তিক দাবি করে এই বিতার্কিকদের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুই পক্ষের বাহাস-পাল্টা বাহাস জমছে খুব। তবে শেষ পর্যন্ত এই টোল হার যে কমছে না সেটি একদম স্পস্ট। এই টোলের সঙ্গে ঢাকা- ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের টোল যুক্ত হলে দক্ষিণবঙ্গগামী সকল যানবাহনের খরচ বাড়বে। খরচ বাড়বে পণ্য পরিবহন ও মানুষের যাতায়াতে। তারপরও নাকি সেটি সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। যেই দুয়ার দিয়ে দখিনা বাতাস ঢুকবে হু হু করে। তাতে সমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি। 

মধ্যবিত্ত মানেই শ্রমিক। এই শ্রেণির শ্রম অফিসে বিক্রি হয়। ভদ্রোচিত পোষাকের আড়ালে এইসব শ্রমিকদের আয় সীমীত। তারা মাস গেলে টাকা পায়। তাই হিসাবটা খুব পাকা হতে হয়। আরেক শ্রেণির শ্রমিক রয়েছে যারা কায়িক শ্রম দেয়। তারা শ্রমিক হলেও দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির সঙ্গে তাদের আয়ও উর্ধমূখী হয়। একজন রিকশা চালক ২০ টাকার রিকশাভাড়া মুহূর্তেই ৩০ টাকা করে ফেলে। একজন দিনমজুরের ৭০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করে ফেলে। কিন্তু ভদ্রোচিত শ্রমিকদের সেই সুযোগ নেই। কেননা বেতন বাড়ানোর ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। সেই ক্ষমতা তাদের প্রতিষ্ঠানের মালিকদের হাতে। পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণবঙ্গে মিল-কারখানা হবে। শিল্প মালিকরা পূর্ব-পশ্চিম আর উত্তরমুখী বাণিজ্যের পর এবার দক্ষিণমুখী বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে উদ্যোগী হবেন। পদ্মা সেতু তাদের পণ্য পরিবহন করে ঢাকায় নিয়ে আসবে। শ্রমিকের দাম বাড়বে। বিদেশীরা আমাদের বন্দর ব্যবহার করে সরকারকে অর্থ দেবে। সবমিলে সমৃদ্ধ হবে অর্থনীতি। অর্থনীতির এই সমৃদ্ধকরণে শিল্পমালিকদের অনেক বড় অবদান থাকবে। তবে আমাদের মতো মধ্যবিত্তের সেখানে তেমন বড় কোনো অবদান রাখার সুযোগ নেই কেবল বাড়তি বাস ভাড়া দেওয়া ছাড়া।

কোনো সন্দেহ নেই পদ্মা সেতু এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় স্থাপণা। দেশীয় অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করে বিশ্ব ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবাক করে দিয়েছে বাংলাদেশ। এটি খুলে দেওয়ার পর থেকে দক্ষিণের ২১ টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সংযোগপথ কমে যাবে। কলকাতার সঙ্গেও কমে যাবে রেলপথ। এই সেতু পার হয়ে অনেক কম সময়ে রাজধানীতে আসতে পারবে মানুষ। অনেক রোগী লঞ্চ কিংবা ফেরির ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়া কম সময়ে ঢাকায় এসে উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবেন। 

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির বাগানে সংবাদকর্মীদের নিয়মিত আড্ডা জমে। সেখানে দেশ-জাতির নানা প্রসঙ্গ নিয়েই আমাদের আলোচনা-সমালোচনা হয়। নিয়মিত এই আড্ডা আসলে মনখুলে কথা বলার একটা সুযোগ। পেশাগত চাপের মধ্যে যতটুকু সময় আড্ডায় থাকি ততোটুকুই যেন স্বস্তি। সেখানে কথা হচ্ছিল পদ্মা সেতু নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন সেতু হবার পর প্রতি সপ্তাহে গ্রামের বাড়ি যাব। কেউ পনেরো দিনের মাথায়। আমি বললাম আমিও যেতে চাই। কিন্তু মধ্যবিত্ত চাকরি করে সপ্তায় সপ্তায় বাড়ি যাবার গাড়ি ভাড়া পাবো কোথায়? দেখলাম আরো জনাদুয়েকের মুখ চুপসে গেলো। বাস্তবতা সেটিই। সেতু আমাদের পথ কমাবে কিন্তু বাড়াবে পাথেয়। এই বাস্তবতায় কায়িক শ্রম বেচা শ্রমিক শ্রেণি কিংবা শিল্পশ্রেণি যতটানা উপকৃত হবে ততোটা উপকারভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণি হতে পারবে না। উপরন্তু এই শ্রেণি বেশ আগে থেকেই এই সেতুর প্রেশার অনুভব করছে। সেতু থেকে অর্থনীতি উপকার পাওয়ার বেশ আগে থেকেই আমরা পকেটের টাকা দিয়ে অর্থনীতিকে একটু বেশিই সাপোর্ট দিয়ে আসছি। এই সাপোর্ট ভবিষ্যতে অব্যাহত রাখতে হবে। এর বিকল্প নাই। নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি করে বিশ্ব দরবারে আমরা অনন্য মর্যাদা পেয়েছি। তবে তার সঙ্গে বোধ করছি কিছু অর্থনৈতিক চাপ। যেই চাপ বা প্রেশার মধ্যবিত্ত শ্রেণির গায়েই বেশি লাগবে।

অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলেন, বিদেশী অর্থায়ন কিংবা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশীপ চুক্তিতে এই সেতু করা গেলে এমন প্রেশার অনুভূত হতো না। কিন্তু সেটি হয়নি। তারপরও আমাদের সৌভাগ্য যে সেতুটি হয়েছে। আমরা গর্ব করে বলবো ‘এই সেতু আমার টাকায় বানানো, আমিই মালিক’। বিজ্ঞজনের বলেন, কোনো নাগরিক যখন রাষ্ট্রীয় কোনো সম্পদকে নিজের মনে করে ব্যবহার করে তখন তাতে ভালোবাসা মিশে থাকে। আর এই ভালোবাসাই হলো ‘দেশপ্রেম’। আর দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।   

লেখক: সাংবাদিক, কথাশিল্পী।
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের