বৃহস্পতিবার,

২৮ মার্চ ২০২৪,

১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৃহস্পতিবার,

২৮ মার্চ ২০২৪,

১৪ চৈত্র ১৪৩০

Radio Today News

হরলিক্স খাওয়ালেই টিকটিকি কুমির হয় না   

প্রকাশিত: ২২:৪১, ১৭ জুন ২০২২

Google News
হরলিক্স খাওয়ালেই টিকটিকি কুমির হয় না   

শিরোনামটি সাংবাদিক বড় ভাই সাঈদ খানের। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির বাগানের আড্ডা থেকে নেওয়া। দীর্ঘদিন মাথায় ঘুরছিলো। তবে লেখার মতো জুতসই কোনো বিষয় পাচ্ছিলাম না। অবশেষে সেই সুযোগ হলো। মনে হলো এখন না লিখলে আর কবে। কোনো একটি শিরোনাম কিংবা আইডিয়া দীর্ঘদিন কোনো সাংবাদিকের মাথায় থাকলে সেটি খুব নিপীড়ণ করে। রাতে ঘুম ভাঙলেও সেটি মনে আসে। বাথরুমে গেলে সেটি আরো গভীরভাবে ভাবায়। এই ভাবাভাবি থেকে বাঁচতেই তাই আজ শিরোনামটিকে পূঁজি করলাম।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাহেব বেশকিছুদিন ধরে মিডিয়াতে সরব রয়েছেন। আর মিডিয়ায় সরব মানে হলো তিনি কাজে তৎপর। তার এই তৎপরতা বেড়েছে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি টার্গেট নির্ধারণ করলেও কুসিক নির্বাচনকে তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। কেননা ‘মর্নিং সোজ দ্য ডে’। তাই সকাল বেলার যাত্রা শুভ করতে তিনি যারপরনাই ব্যস্ত। 

সাপ্তাহিক নবযুগে এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে তখন কুসিক নির্বাচন শেষ হয়ে যাবে। মেয়র হিসেবে পুরনো মনিরুল হক কিংবা অপর দুই প্রার্থীর যে কেউ বিজয়ী হবেন। ততোক্ষণে নতুন ইসির ‘সকালবেলা’টা কেমন হলো সেটিও সবার জানা হয়ে যাবে। তাই তাকে নিয়েই এবারের আলোচনা। 

সকালটি কেমন যাবে সেই পরীক্ষা বোধ হয় ইতোমধ্যে আউয়াল কমিশন দিয়ে দিয়েছেন। এবং সেই পরীক্ষায় তিনি যে খুব ভালো করতে পারেননি সেটিও খুব স্পস্ট। কেননা সেখানকার স্থানীয় সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আ.ক.ম বাহারউদ্দিন বাহারকে তিনি এলাকা ছাড়তে বলেছিলেন। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ি সেটাই হওয়া উচিত ছিলো কিন্তু এমপি বাহার সেটি মানেননি। পুরো কমিশনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কুমিল্লা শহরেই রয়েছেন তিনি। কেবল থাকলেও সেটি ছিলো কিছুটা স্বস্তির। পাশাপাশি তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজও করছেন। তার সেই প্রচার-প্রচারণার বিভিন্ন কার্যক্রম গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের চোখে পড়ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে ‘এও কি সম্ভব?’

জি, প্রিয় পাঠক এটি সম্ভব এবং শতভাগ কার্যকরী। নির্বাচন কমিশন দেশে একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমুলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে মতবিনিময় করছে। সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ বিভিন্ন বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞজন এ নিয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিচ্ছেন। কমিশন সমৃদ্ধ হচ্ছে। জনগণের মধ্যে আশা না জাগলেও একধরণের আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। আগামীতে একটি অপেক্ষকৃত কম ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- কারো কারো মনে এমন ধারণাও জন্মাতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় এমপি বাহারের এমন বেআইনী কাজ ইসিকে আবারো অতীতের গ্লানিমাখা পথে ঠেলে দিচ্ছে। জনগণের মধ্যে গেঁড়ে থাকা সংশয়-সন্দেহ-অবিশ্বাসকে বুঝি আর উপড়ে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না। কেননা খোদ সিইসিই তার পূর্বের জোরালো ঘোষণা থেকে ইউটার্ণ নিয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এমপি বাহার স্বেচ্ছায় এলাকা না ছাড়লে এখানে কমিশনের কিছুই করার নেই’। তার মানে তো তাই। পূর্বের রকিব কিংবা জঘন্য হুদা কমিশনের ধারাবাহিকতা।

ঢাকা থেকে ইতোমধ্যে অনেক সংবাদকর্মী কুমিল্লা সিটিতে গিয়েছেন নির্বাচনী খবরাখবর সংগ্রহে। সোমবার প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিকের গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিলো কমিশন বনাম বাহারের অসম যুদ্ধের খবর। সেই যুদ্ধে কমিশনের করুন পরাজয়ের খবর ছেপেছে তারা। বলছেন, ‘বাহারের কাছে কমিশনের অসহায় আত্মসমর্পণ’, কেউ লিখছেন ‘ কুমিল্লায় বাহারের বাহাদুরি’। এই ধরণের অসংখ্য শিরোনাম রয়েছে পত্রিকা-অনলাইনে। টেলিভিশনের খবরেও আসছে বাহারকান্ড। সবমিলে হাটে হাড়ি ভেঙে যাওয়ার মতো একটা খবর। 

দেশে এখন চলছে পদ্মাসেতু হাইভ। সরকারের সবাই তাকিয়ে আছেন ক্যালেন্ডারের পাতায়। ২৫ জুন কবে আসবে। কবে উদ্বোধন করা হবে পদ্মাসেতুর। সে কারনে দেশের ভেতরে এমন বেআইনী-জঘন্য একটি কাজ ঘটে চলেছে সেদিকে কারো কোনো নজর নেই। সরকারের পক্ষ থেকে দু’দিন আগেও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী, ক্ষমতাসম্পন্ন কিংবা স্বাধীন বলে যে তকমা দেওয়া হয়েছিলো তার এমন করুন পরাজয় কি করে মানবে তারা? কি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দলীয় মুখপাত্ররা এই অপবাদ ঢাকবেন। কি করে সামলাবেন কাজী আউয়াল সাহেব। 

আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পর থেকে আওয়ামী লীগ তিন মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে। এর মধ্যে গত দুই মেয়াদে সেই অর্থে দেশে কোনো নির্বাচন হয়নি। তারা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতায় বসেছে। সেই ক্ষমতার সাধ তারা সহসাই যে ত্যাগ করবে না সেটি সহজেই অনুমেয়। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। যাতে দেখা গেছে তিনি কেবল ক্ষমতাই চান। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি দেশের উন্নয়ন করতে চান বলেও ওই ভিডিওতে শোনা গেছে। তার এই ভিডিও স্যোশাল মিডিয়ায় অনেক শেয়ার হচ্ছে। বিশেষ করে কুমিল্লা সিটিতে নির্বাচন কমিশনের পরাজয়ের পর প্রধানমন্ত্রীর ওই ভিডিও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছেন অনেকে। নেটিজেনদের অনেকেই আগামী নির্বাচনেও বিগত দুই নির্বাচনের ভুত কিংবা অন্য কোনো ফরমেটে ভুত ফিরে আসবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। এই অবস্থায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের যে কোনো তৎপরতাকেই যে কেবলই লোক দেখানো সেটি ভাবারও হয়তো যথেষ্ট যুক্তি পাওয়া যাবে।   

অতীতের অন্তত জনা চারেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার সম্প্রতি এক সেমিনারে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তাদের সবার মতামত প্রায় একই রকম। তা হলো- দলীয় সরকারের অধীনে আসলেই নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব না। মজার ব্যাপর হলো সদ্য বিদায়ী এবং ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা সাহেবও এ ধরণের মন্তব্য করেছেন। তার এই মন্তব্যের পর আবারো তিনি ভাইরাল হয়েছেন। সেই ভাইরাল যতো না বক্তব্যের কারণে তার চেয়েও বেশি বোধ হয় তার অতীত কর্মকান্ডের কারনে। সে যাই হোক চেয়ার থেকে বিদায়ের পর তার এমন সত্য কথন কিংবা উপলব্ধি নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রকৃত অবস্থা তেমনই। আমাদের দেশে একটি সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করবে আর সেই নির্বাচনে অন্য দল বা জোট বিজয়ী হয়ে মসনদে আসীন হবে এমনটা ভাবাও হয়তো অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। বিশেষ করে অতীতের দুটি নির্বাচনের চিত্র এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ভিডিও বার্তা সেটাই প্রমাণ করে। 

সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটি ঠিক। কিন্তু সেই ক্ষমতার নাটাই যে অন্যের হাতে তথা সরকারের হাতে সেটিও আমাদের বুঝতে হবে। সে কারনেই নির্বাচন কমিশনকে রাজনীতির ভাষায় নখদন্তহীন বাঘ বলা হয়ে থাকে। এই নখদন্তহীন বাঘ যে নিজস্ব হাতিয়ার দিয়ে কোনো বিড়ালও মারার ক্ষমতা রাখে না সেটি এতোক্ষণ নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন প্রিয় পাঠক। না বুঝে থাকলে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে এমপি বাহারের কথা আরেকবার মনে করুন। সামান্য একটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। একজন মাত্র এমপি। কমিশনের সর্বশক্তি দিয়েও তাকে একচুলও নড়ানো যায়নি। তাহলে জাতীয় নির্বাচনে এই কমিশন সারাদেশের এমন ৩০০ বাহার এবং এসব বাহারদের লাখ লাখ গুন্ডা-পান্ডার বহর কি করে সামলাবেন? এটা কি আদৌ সম্ভব? কোনো ভাবেই না। কস্মিনকালেও নয়। তাই আপনারা যারা স্বাধীন কিংবা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন করে করে গলা ফাটান, নির্দলীয় অথবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে অস্বীকার করে এই কমিশন দিয়ে এই সরকারের অধীনেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বপ্ন দেখেন তাদের উদ্দেশ্য আসলেই ভালো নয়। যুক্তি-তর্ক যাই করুন অন্তত একটি বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হবেন তা হলো- দেখতে একই রকম মনে হলেও হরলিক্স খাওয়ালেই টিকটিকি কুমির হয়ে যায় না। 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। 
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের