শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪,

১৫ চৈত্র ১৪৩০

শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪,

১৫ চৈত্র ১৪৩০

Radio Today News

মসজিদে মুসলমান বাজারে ব্যবসায়ি 

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ৮ এপ্রিল ২০২২

Google News
মসজিদে মুসলমান বাজারে ব্যবসায়ি 

প্রতিকী ছবি


ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে একজন মাঝ বয়সী মহিলা সরকারকে ভৎসনা করছেন। তার আশপাশে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে। কেউ একজন তার কথাগুলো রেকর্ড করছেন। মহিলার কথাগুলো মর্মস্পর্শী। বুক চাপড়ে ক্ষুধার জ্বালার সে বয়ান কেবল একজন ক্ষুধার্তই দিতে পারেন। পৃথিবীর অন্য কেউ এতো প্রাঞ্জল, এতো প্রাকৃতিকভাবে কথাগুলো বলতে পারবে না। সে যত বড় অভিনেতাই হোক। মহিলার অভিযোগ জিনিশপত্রের দাম বেশি। কিভাবে কিনবেন তিনি। তার একটা হাত নেই। কামাই করার পুত নেই। স্বামী নেই। এক মুখের সংসার চালিয়ে নিতে তার অন্তত দশটি হাত প্রয়োজন ছিলো। অথচ তার আছে একটি মাত্র হাত। এই এক হাতের কাম, কামাই দিয়ে কি করে বেঁচে থাকবেন এই দুর্মুল্যের বাজারে? মহিলা কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন। মুখের কথায় তার অগ্নি ঝরে। এই অগ্নি ঝরা কথাগুলো তাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। পেটের ক্ষুধা তাকে বিদ্রোহ-বিপ্লবের মন্ত্র শিখিয়েছে। 

আমাদের দেশে এই ধরণের বিপ্লবী মানুষের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। পেটের ক্ষুধা নিবারণের যে সংগ্রাম এর চেয়ে বড় সংগ্রাম আর নেই। সেই সংগ্রামী মানুষের ভাষা খুব জ্বালাময়ী হয়। তাদের বক্তব্যেও থাকে আগুন। সেই আগুনে কখনো কখনো ক্ষমতাবানদের মসনদ পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আবার কখনো নিজেরাই পুড়ে যায় নিজেদের মুখের ভাষায়। 

পবিত্র রমজান মাস চলছে। সিয়াম-সাধনার এ মাসে মানুষ সারা বছরের আত্ত্বিক ময়লা ছাফ করার মিশন নিয়ে নেমে পড়ে। বিশেষ করে আমাদের দেশের তথাকথিত মুসলমানদের মধ্যে রমজান মাস নিয়ে এক ভিন্নধর্মী আবেগ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি লক্ষ্য করা যায়। মসজিদে মুসল্লীদের সংখ্যা বেড়ে যায়। তারাবীর নামাজে কাতারের সংখ্যা বাড়ে। প্রথম কয়েকদিন সাপ্তাহিক মুসুল্লীদের চাপে নিয়মিত মুসুল্লীদের কোনঠাসা অবস্থা বিরাজ করে। ইফতারের বাজারে এসব মুসুল্লীদের দাপটও চোখে পড়ার মতো। তাদের ইফতারের আয়োজন দেখে মনে হয় রোজা কেবল তারাই পালন করছে। রোজায় কষ্ট কেবল তাদেরই হয়। অন্যদের শরীরে ক্ষুধা-ক্লেশ ভাব নেই। তাই তাদের বিষয়টি মাথায় থাকে না। এইসব বাড়াবাড়ি রকমের বাজার করতে গিয়ে দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে এক ধরণের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। যে কারনে আমাদের বাজারগুলো হয়ে পড়ে গলাকাটা বাজার। যার টাকা আছে তার ঘরে হরেক রকম খাবারের পসরা। আর যে মধ্যবিত্ত কিংবা নি¤œবিত্ত সে কোনো রকম বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত থাকে। এই যে ভারসাম্যহীন একটি পরিবেশ এ কেবল আমাদের দেশেই হয়ে থাকে। মোটামুটি রোজার মাস মানে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের মুনাফা কামানোর মাস। এক টাকার পণ্য তিন টাকা বিক্রি করে কীভাবে সারা বছরের ব্যবসা এক মাসে করা যায় তা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ছাড়া আর কেউ বোধ হয় ভালো জানে না। 

রোজা শব্দটি ফার্সি হলেও এটিই আমাদের দেশে বেশি প্রচলিত। সিয়াম তার কুরানিক ভাষা। যার শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা। ইসলামের তৃতীয় মূল ভিত্তি। পবিত্র কোরআনের সুরাতুল বাক্বারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘রমজান মাস, এতে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের জন্য হিদায়ত স্বরুপ এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী’। 

এই আয়াত ছাড়াও কোরআনের অন্যান্য আয়াত ও রাসুলের বানী তথা হাদিসে সিয়ামের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে সুস্পস্টভাবে বলা হয়েছে। সে সব নির্দেশনার সারাংশ করলে দাঁড়ায় যে এটি ‘আত্ম সংযম এবং অন্যের কষ্ট অনুধাবনের মাধ্যমে নিজের বিবেককে পরিচালিত করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম’। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমাদের দেশে এখন রমজান মাস আসলে একটি বিশাল শ্রেণি মনে মনে অসন্তুষ্ট হয়। এই অসন্তোষ এই ভেবে নয় যে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা ফরজিয়াতকে অবজ্ঞা করা। বরং এই অসন্তোষ এই ভেবে যে, এই মাসে তাদের খরচ বেড়ে যায়। কোনো কোনো পরিবার সেই অতিরিক্ত খরচ কোনো মতে সামাল দিতে পারলেও অনেক পরিবার রয়েছে তারা সেটি সামাল দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন না। ফলে তাদের কষ্ট বেড়ে যায় কয়েকগুন। 

সেদিন ফেসবুকে আমার এক পরিচিত ছেটো ভাই একটি ছবি পোস্ট করেছে। ছবিতে দেখা গেছে, ঘরের মেঝেতে কয়েকফালি তরমুজ ছড়িয়ে রয়েছে। তার বর্ণনায় যেটি বোঝা গেলো, ইফতারের জন্য তরমুজগুলো চড়া দামে কিনতে হয়েছে। দোকানির কথা মতো সেগুলো মিষ্টি নয়, বিচিগুলো সাদা, দেখে মনে হয় রংটাও নকল। তার ধারণা এই তরমুজেও কেমিক্যাল মেশানো। অর্থাৎ রোজায় অধিক মুনাফা পাওয়া লোভে একদল লোক এই অপরিপক্ক তরমুজে কেমিক্যাল মিশিয়ে সেগুলো বিক্রি করছে। আর মানুষ তাদের কষ্টার্জিত টাকায় সেগুলো কিনে আর্থিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। 

শুধু কি তরমুজ। বাজারে সব ধরণের পণ্যের দামই বেড়েছে। গেল প্রায় বছর খানেক ধরে বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাধারণ মানুষের হাহাকার এখন রীতিমত স্লোগানে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে রোজা শুরু হয়ে যাওয়ায় এখন বাজারে চলছে নৈরাজ্য। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অনেকটা আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তার অসহায়ত্ব গণমাধ্যমের খবর হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের যে অসহায়ত্ব আজ ক’বছর ধরে চলছে সেটি আমাদের গণমাধ্যম খুব কমই তুলে আনছে। শহর থেকে গ্রামে সবখানেই যে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী দিনকে দিন দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে এবং বিপরীতে একটি গোষ্ঠী যে সম্পদের চূড়ায় আরোহন করছেন সে বিষয়টিও প্রায় আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এই যে ভারসাম্যহীন একটি দেশ ধীরে ধীরে আমাদের চোখের সামনে তার পূঁজিবাদী-ভোগবাদী চরিত্র প্রকাশ করছে এর ভবিষ্যত কী?

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ রমজানে সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে বিশেষ স্কিম চালু করে। ব্যবসায়িরা নিত্যপণ্যে মুনাফার বদলে ডিসকাউন্ট অফার দেয়। কোনো কোনো পণ্য রোজাদারের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রিও করে দেয়। তারা এই মাসকে পূণ্য কামাইয়ের মাস হিসেবে লুফে নেয়। অথচ আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে এটি মুনাফা কামাইয়ের মাস। অথচ আমরা জোর গলায় দাবি করি এই দেশ ৯০ ভাগ মুসলমানের। এই মুসলমান লইয়া আমরা কি করিব? যেই মুসলমান কেবল মসজিদের চার দেয়ালের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। এই মুসলমানিত্বের মর্তবা আসলে কোথায় যারা কেবল সেহরীতে উপাদেয় খাবার আর ইফতারের বাহারী আয়োজনকে রোজা মনে করে? এই রোজাদারের শরীরের যাকাত কি করে আদায় হয় যাদের শরীরের ওজন এই মাসে কমার বিপরীতে বরং বাড়ে? এমন অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে কিন্তু সঙ্গত কারনে প্রশ্নের পরিধি আর বাড়াচ্ছি না। 

তবে একটি কথা না বললেই নয়, আমাদের দেশে এই তথাকথিত মুসলমান দিয়ে আসলেই কোনো কাজ হবে না। না এই লোকগুলো নিজেরা ইসলাম ধর্ম বোঝে, না বোঝে মানবধর্ম। সিয়াম বা রোজা এই লোকগুলোর জীবনে আসলেই কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। এদের জন্য কাল কেয়ামতের হিসাব নি:সন্দেহে অনেক কঠিন ও ভয়ানক হবে বলে আমার বিশ্বাস। পবিত্র রমজান মাসকে যারা কেবলই মুনাফা অর্জনের মাস বানিয়ে ফেলেছে তাদের হিদায়াত কামনা করি। জানি গরীবের হাহাকার তাদের হিদায়াতের পথকে সংকীর্ণ করে দিচ্ছে তবুও প্রার্থনা থাকবে যেন তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়। তারা যেন রমজানের সঠিক শিক্ষা ও তাৎপর্য বুঝে সেই অনুযায়ি আমল করতে পারে আল্লাহর কাছে সেই তাওফিক কামনা করি। 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী।   
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের