শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪,

১৫ চৈত্র ১৪৩০

শুক্রবার,

২৯ মার্চ ২০২৪,

১৫ চৈত্র ১৪৩০

Radio Today News

মিষ্টি কুমড়ার বেগুনি `তত্ত্ব `

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২২:১৬, ১৫ এপ্রিল ২০২২

Google News
মিষ্টি কুমড়ার বেগুনি `তত্ত্ব `

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ভোটের মাঠ নিয়ন্ত্রণে যতোটা না সফল ঠিক ততোটাই ব্যর্থ বাজার নিয়ন্ত্রণে। বিগত এক দশক ধরে নিত্যপণ্যের আগুন এদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবনকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেইসঙ্গে বাড়ি ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি, পরিবহন ভাড়া, মোবাইল কলরেটসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধার সবগুলো যায়গায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তারা। তাদের এই ব্যর্থতার বিষয়টি রমজান মাস এলে বেশি করে সামনে আসে। একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় বাজারে। যার নিয়ন্ত্রণে শক্তিশালী সিন্ডেকেট। অথচ এই নিয়ন্ত্রণটি থাকার কথা ছিলো সরকার বাহাদুরের হাতে।

মাত্র কয়েকদিন আগে রাজধানীতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির একটি প্রতিবাদ কর্মসূচী থেকে বিএনপির একজন জনপ্রিয় তরুন নেতাকে আটক করেছে পুলিশ। ওই নেতার বিশেষ পরিচয় হলো তিনি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা অবিভক্ত ঢাকার সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। ইতোপূর্বে মেয়র নির্বাচন করেছেন। কিন্তু এই সরকারের ব্রান্ডিং নির্বাচনের কাছে তিনি মেয়র হতে পারেননি। তাই তাকে জনতার মেয়র বলা হয়। তিনি যেখানেই যান তার পেছনে কর্মী-সমর্থকের ঢল নামে। নেতা-কর্মীদের তিনি আগলে রাখেন নিজের জীবন বিপন্ন করে। যার প্রমান ইতোমধ্যেই পেয়ে গেছে এদেশের মানুষ। ইশরাককে আটক করার ভিডিওতে দেখা গেছে একজন পুলিশ অফিসার প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকাকে গালি দিচ্ছেন। আঙ্গুল উচিয়ে শাসাচ্ছেন তাকে। সবমিলে একটি ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ। এই আচরণ একটি গোষ্ঠী কিংবা যে কোনো পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমাদের দেশের বাহিনীগুলো করে থাকে। আমরা যতই বলি তারা আমাদের সেবক, রক্ষক কিংবা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী আদতে তা নয়, তারাই আমাদের নিয়ন্ত্রক-নির্যাতক। এই নিয়ন্ত্রণ ও নির্যাতন কি কেবলই বিরোধী মত দমনের জন্য প্রযোজ্য? এই শক্তি ও ঔদ্ধত্ব কি কেবলই নির্বাচনের মাঠকে ক্ষমতাসীনদের বশে আনার কৌশল? উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। কেননা সহজ কথা যায় না বলা সহজে। 

দেশে প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক পরিবেশ নেই। রাজপথে জনগণের দাবি নিয়ে কোনো কর্মসূচী নেই। যেটুকু হয় সেখানেও সরকারের দমন-পীড়ণ চলমান। যার সর্বশেষ উদাহরণ দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি নিয়ে বিএনপির কর্মসূচী থেকে দলটির জনপ্রিয় নেতাকে গ্রেপ্তার করা। ইশরাককে গ্রেপ্তারের পর আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগার পাঠানো হয়েছে। ফের জামিন শুনানী হবে আগামী মে মাসে। অর্থাৎ আসছে ঈদুল ফিতর তাকে কারাগারেই কাটাতে হবে। এরপরও কোনো নেতা, কোনো রাজনৈতিক দল কি জনগণের ইস্যু নিয়ে মাঠে সরব হতে সাহস পাবেন? হয়তো পাবেন, হয়তো পাবেন না।  কেননা আজ নেকড়ে অরণ্যে সিংহরাও ধরাশায়ী। এখানে তাদের জীবনেরও ঝুঁকি রয়েছে। 

এবার মূল আলোচনায় আসি। রমজান এলে প্রতিবারই বেগুনের দাম বাড়ে। বাড়ে লেবু, শসা, পেঁয়াজসহ আরো বেশ কিছু পণ্যের। এই পণ্যগুলোর চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারনেই মূলত একটা অসাধু সিন্ডিকেট দাম বাড়িয়ে থাকে। তবে এর ভেতরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর হলো এইসব পণ্যসহ কাঁচামালের দাম বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী পণ্যপরিবহনে চাঁদাবাজি। মালিক সমিতির দেওয়া তথ্য বলছে, এই চাঁদাবাজের নিয়ন্ত্রণ পুলিশের হাতে। তাদের সেন্ট্রাল চাঁদার পাশাপাশি আরো চাহিদা মিটিয়েই এইসব পণ্য বাজারে ঢুকতে পারে। কেবল রমজানেই ৯শ কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়। যে কারনেই ৩০ টাকার বেগুন ১০০ টাকা। ১০টাকার লেবু ৪০ টাকা, ১০০ টাকার ধনেপাতা ২৫০ টাকায় কিনতে হয় ক্রেতাকে। 

ইফতারে বেগুনি খায় রোজাদার। সেই বেগুন কেন এতো দাম হবে। কৃষকের কাছ থেকে ২০ টাকা দরে কিনে আনলেও বাজারে কেন এর দাম শ’ছাড়াবে। এই প্রশ্ন রমজান এলেই ঘুরেফিরে উঠে আসে গণমাধ্যমে। এবার সেই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি এ নিয়ে কথা বলেছেন। দিয়েছেন সমাধান। বলেছেন ‘রমজানে বেগুনি না খেলে কি হয়। বেগুনির বদলে বরং মিষ্টি কুমড়া দিয়ে বেগুনি বানান। আমরাও তাই করি’। আরো অনেক কথা। 

প্রধানমন্ত্রীর এই ‘বেগুনি তত্ত্বের’ পর বিভিন্ন মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া উঠে আসছে। কেউ কেউ সমালোচনা করতে গিয়ে কারাগারে গিয়েছেন। আবার কেউ কেউ এই তত্ত্বের তথ্যকে কাজে লাগিয়ে মিষ্টি কুমড়া দিয়ে ঠিকই বিকল্প আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তবে নাম নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। প্রধানমন্ত্রী চট করে কুমড়া দিয়ে বেগুনি বানানোর কথা বললেইতো হলো না। নামকরণের একটা স্বার্থকতাতো থাকতে হবে। তাই কেউ এর নাম দিয়েছেন ‘কুমাড়ি, আবার কেউ ‘কুমড়ানি’। নাম যাই হোক কুমড়া দিয়ে যে জিনিশটা করা গেছে এটা তো সত্য। 

ফেসবুক, ইউটিউবে চমৎকার সব ভিডিও ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে দেখতে অবিকল বেগুনির মতো হলেও আকারে অনেকটা বেটে, মোটা। স্বাদ কেমন তা চেখে দেখা হয়নি। হয়তো ভালোই হবে। যেহেতু আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসায় সেটির প্রচলন রয়েছে সুতরাং স্বাদে মন্দ হবার কথা নয়। তাই ধরে নিলাম সুস্বাদুও বটে। যদিও বাগেরহাটের যুব মহিলা লীগের সদস্যরা তা বলছেন না। তাদের ভাষ্যমতে এটি স্বাদে খুবই বিশ্রি, মুখে দেওয়া যায় না। এর জেরে ওই দুই সদস্যকে দলীয় পদ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কুমড়া দিয়ে বেগুনি বানিয়ে ফানি পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। যা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তামাশা করার শামিল।  

কিছুদিন আগে আমাদের কৃষিমন্ত্রী চালের দাম বাড়ার পেছনে বেশি ভাত খাওয়াকে দায়ি করেছিলেন। পরামর্শ দিয়েছিলেন দেশের নাগরিকরা যেন ভাত কম খান। এরও আগে খাদ্য তালিকায় কচুরিপানা কি করে অন্তর্ভূক্ত করা যায় তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এক মন্ত্রী। এই সবই দেশের মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। বরং দেখেছে দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার ফন্দি হিসেবে। 

আসলেই আমাদের দেশের রাজনীতিকরা ভালো ফন্দি জানেন। জনগণের সামনে মুলা ঝুলিয়ে বছরের পর বছর তাদের ন্যায্য দাবি থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হন তারা। বিশেষ করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি কিংবা পরিবহন ভাড়া নিয়ে যখনই আন্দোলন হয়েছে তখনই ছাত্রলীগসহ সরকার দলীয় বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন কিংবা পুলিশ প্রশাসন তা দমিয়ে দিয়েছে। হামলা করেছে। এই হামলার কারনেই দেশে এখন আর কেউ কোনো কিছুতেই প্রতিবাদ করার সাহস করে না। তাই জনগণের দূর্বলতাকে নিয়ে তারা উপহাস করে মজা পান। এই উপহাস যখন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছ থেকে আসে তখন তাকে উপহাস না বলে নতুন ‘তত্ত্ব’ বলি। কেননা আওয়ামী লীগের টানা প্রায় দেড় দশকের মেয়াদে আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা বেশ ভালো করেই এইসব শব্দ প্রয়োগের স্থান বুঝে গিয়েছি। একই কাজ বিএনপির কোনো নেতা করলে সংবাদে কোন ধরণের ভাষার প্রয়োগ করতে হবে আর আওয়ামী লীগের কোনো নেতা করলে কেমন ভাষার ব্যবহার হবে সেটি আমাদের চেয়ে আর কে ভালো জানে। 

চাঁদাবাজির কারনে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে এই কথা খোদ পরিবহন মালিকদের। বাজার বিশ্লেষকরাও চাঁদাবাজিকে অন্যতম কারন হিসেবে মনে করেন। এরপর রয়েছে ব্যবসায়ি সিন্ডিকেট। এই চাঁদাবাজ আর সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি দেশের কোটি কোটি মানুষ। অথচ সেখানে সরকারের কোনো নজর নেই। তাদের থামাতে প্রধানমন্ত্রীর কোনো ‘তত্ত্ব’ নেই। যত তত্ত্ব গরীবের রুচির উপর। ইফতারিতে এক, দু পিচ বেগুনি খাবে সেখানেও ছাড় দিতে হবে এই সাধারণ মানুষকেই। অথচ এইসব চাঁদাবাজ আর কালোবাজারিরা থাকবে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কেননা এরা তাদেরই লোক যারা জনগণের সঙ্গে উপহাস করে। যারা জনগণের ভোটাধিকার, মানবাধিকার কিংবা সুশাসন হরণ করে উন্নয়নের মুলা ঝুলিয়ে বিরামহীনভাবে দেশ শাসনের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী।
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের