বৃহস্পতিবার,

২৫ এপ্রিল ২০২৪,

১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহস্পতিবার,

২৫ এপ্রিল ২০২৪,

১২ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

মুসলিম আমি, চির বিপ্লবী  

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২২ এপ্রিল ২০২২

Google News
মুসলিম আমি, চির বিপ্লবী  

পবিত্র রমজান চলছে গোটা মুসলিম বিশ্বে। এ সময়ে মুসলমানরা শরীর ও মনের পরিপূর্ণ সংযোগ ঘটিয়ে সিয়াম-সাধনায় লিপ্ত থাকে। এর মাধ্যমে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়। রমজানে দৈনন্দিন অনেক কাজ কমিয়ে আনার পাশাপাশি পারস্পারিক সহযোগিতামূলক কাজেও মুসলমানরা আত্মনিয়োগ করে থাকে। শিশু থেকে বয়স্ক, সব শ্রেণির মানুষের মধ্যেই এই ধরণের মনোভাব পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে বরাবরই তার উল্টো। রমজান এলেই তাদের যুদ্ধ আরো বেড়ে যায়। দখলদারদের অত্যাচার মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তারা আরো বর্বর হয়ে উঠে। এর আগেও বিভিন্ন সময় পবিত্র রমজানে ফিলিস্তিনিদের রক্তে হলি খেলেছে তারা। এ বছরও সেটি চলছে। তাদের জুলুম নির্যাতন থেকে রেহাই মিলছে না ছোট্ট শিশু থেকে দাঁড়ি পাকা মুরুব্বির। বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া থেকে দেশটির শীর্ষ আলেম পর্যন্ত। 

সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ফিলিস্তিনিদের সেই ছবি ছড়িয়ে আছে। ভিডিওতে করুণ, লোমহর্ষক, হৃদয় বিদারক দৃশ্য ঘুরছে। যেই দৃশ্য পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিবেকবান মানুষের রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে। মুসলমানদের হৃদয়ের যন্ত্রণা-ক্ষোভকে আরো উস্কে দিচ্ছে। ভেতরে ভেতরে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে ঈমানদ্বীপ্ত কোটি তরুণ হৃদয়। আমরা সেই দহনে জ্বলছি। 

মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসে ইসরাইলী সৈন্যরা গুলি করেছে নির্বিচারে। সেখানে নামাজরতদের বুনো পাখির মতো গুলি করে মেরেছে। প্রতিরোধে এগিয়ে আসা ছোট্ট ছোট্ট শিশুদেরও পিটিয়েছে বেধড়ক। বৃদ্ধদের মেরেছে নির্মমভাবে। অনেক যুবক রোজা অবস্থায় শহীদ হয়েছেন। অসংখ্য লোককে বন্দী করে নিয়ে গেছে তারা। মোটকথা পূন্যভূমি ফিলিস্তিন এখন ইসরাইলের বানানো এক নরকের নাম। কৃত্রিম এই নরকে ফেলে ইসরাইলী নরপশুরা দাজ্জালের সুখ পাচ্ছে। 

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সে বছর ফিলিস্তিনিদের ওপর চরম আগ্রাসন চালায় ইসরায়েল। কয়েক হাজার ফিলিস্তিনিকে শহীদ করা হয়। বিশ্বব্যাপী সেই হামলার প্রতিবাদ ওঠে। তার অংশ হিসেবে এলাকায় একটি প্রতিবাদী মানববন্ধনের আয়োজন করি। গ্রাম্য বাজারের সেই প্রতিবাদ কর্মসূচীতে বহু লোক সমাগম ঘটে। সোস্যাল মিডিয়ার কল্যানে নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের হাহাকারের চিত্র প্রতিদিনই চোখের সামনে ভেসে আসতো। টেলিভিশনে সংবাদ হতো তাদের নিয়ে। সে সময় গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে গভীর আগ্রহ-আবেগ লক্ষ্য করি।

পরে ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের ডেপুটি হেড অব মিশন ইউসুফ রামাদানের সঙ্গে দেখা করি। সে সময় তিনি তার দেশের জনগণের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের অকৃত্রিম সমর্থন ও সহমর্মিতা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। দীর্ঘ আলাপচারিতায় তিনি ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। বলেন, ‘পৃথিবীতে কোনো ডিকশনারীতেই এমন কোনো শব্দ নেই যা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার কথা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে’। এই একটি লাইনেই তিনি সবকিছু বুঝিয়ে দেন। ইসরায়েলের সেনারা যে মানবতার ন্যূনতম কোনো পরোয়া করে না সেটি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ফিলিস্তিনিরা প্রথমে তাদের জমি দিয়েছে। তারপর বাড়ি-ঘর আর এখন জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করছে। ইহুদিবাদীদের যায়গা দিতে গিয়ে আজ মুসলমানরা সেখান থেকে উৎখাত হচ্ছে। অথচ বিশ্ব আজ চুপ। কেউ কোনো কথা বলে না। মুসলমানদের বেলায় মানবাধিকারের কথা বলে না জাতিসংঘ। আমেরিকাসহ পরাশক্তিগুলো চুপ থেকে তাদের আরো উস্কে দেয়। এই নরক যন্ত্রণার যেন কোনো শেষ নেই। 

আসলেই তাই। বর্তমানে ফিলিস্তিনে যে কত ধরণের নির্যাতন চলছে তা এই একটি নিবন্ধে লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। কত মায়ের আহাজারি যে সেখানের বাতাসে মিশে যাচ্ছে প্রতিদিন তার হিসাব নেই। কত শিশুর আর্তনাদ আর চোখের পানিতে সিক্ত হচ্ছে পবিত্র ভূমি তা বলে বোঝানো যাবে না। অথচ তা নিয়ে কারো যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই। 

ইউক্রেনে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলা চালায় রাশিয়া। দেশটিতে এখনো রুশ বাহিনীর অভিযান চলমান। কোনো পক্ষই এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত পরিণতি পায়নি। এই নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিশ্ব তাদের সর্বোচ্চ মনযোগ জারি রেখেছে। বাংলাদেশও তার অবস্থান থেকে সক্রিয় রয়েছে। বিশ্ব মিডিয়ার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। তারা ২৪ ঘণ্টা নজর রাখছে ইউক্রেনের দিকে। ভøাদিমির পুতিন কিংবা ভলেদিমির জেলেনস্কির মুখের দিকে চেয়ে আছে পৃথিবীর অসংখ্য, অগণিত সংবাদকর্মী। অথচ ফিলিস্তিনের ব্যাপারে তাদের কোনো মনোযোগ নেই। দেশটিতে শত শত মুসলমান নিহত হলেও জাতিসংঘ সেটিকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সেখানে নির্বিকার। আর সৌদিসহ বেশকিছু মুসলিম রাষ্ট্রের সেখানে কোনো ভূমিকা নেই। কোনো কথা বলে না মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সংস্থা ওআইসিও। সব মিলে ফিলিস্তিনিরা এতিম। তাদের কোনো অভিভাবক নেই। এই অভিভাবকত্বহীনতার কারনেই তারা নিজ ভূমে পরবাসী যুগের পর যুগ। 

প্রিয় পাঠক আপনারা নিশ্চয়ই অবগত থাকবেন ভূমধ্যসাগরের পূর্বে মাত্র ১০ হাজার ৪২৯ বর্গমাইলব্যাপী ফিলিস্তিন দেশটি ছিল উসমানীয়  খেলাফতের অধীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল ব্রিটেন-বিরোধী জোটে। নানা ঘটনা পরম্পরায় ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষণা করে ইহুদি জায়নবাদীরা, যাদের প্রধান ছিলেন দাভিদ বেন গুরিয়ন। যিনি পরবর্তীতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন। ১০ মিনিটের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন স্বীকৃতি দেয়। 

এরপর থেকে প্রতিদিনই ইহুদীরা ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্রাসন চালিয়েই যাচ্ছে। যেখানে ইহুদিরা সমগ্র ফিলিস্তিনই প্রায় দখল করে নিয়েছে, সেখানে মাত্র ১৪ একর জায়গার জন্য কেনো এতো অত্যাচার নির্যাতনের পরেও  ফিলিস্তিনের মুসলমানরা বারবার ফিরে যাচ্ছে? মার খাচ্ছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের ইসলামের কিছু ঐতিহাসিক বিষয় সম্পর্কে জানতে হবে। ফিলিস্তিনে অবস্থিত মাসজিদুল আকসা সমগ্র মুসলিম জাতির প্রথম কিবলা, সকল পয়গম্বর সেদিকে ফিরে আল্লাহর ইবাদাত করেছেন, এমনকি মহানবী সাল্লালাহু আলাইহিস সালামও! এখানেই সকল নবী রাসুলদের  নিয়ে নামাজের একমাত্র জামাত হয়েছিল।  সেই জামাতের ইমাম ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

এখান থেকেই হজরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সালাম বোরাকে করে মিরাজ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলেন। এটিই সেই পবিত্র ঊর্ধ্বগামী সফরের দুনিয়ার ষ্টেশন! এই মসজিদের নির্মাণের সাথে জড়িয়ে আছে হজরত আদম (আ.) এবং সুলাইমান (আ.) এর নাম। এ স্থানে সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মহান বীর সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর রাহিমাহুল্লাহর অসংখ্য স্মৃতি। এই মাসজিদ বিনির্মানে জ্বীনদের দ্বারা পাথর উত্তোলন করা হয়েছে সাগরের তলদেশ থেকে। যা কিনা কোন মানুষের পক্ষে অসম্ভব!( সুলাইমান আ. এর নির্দেশে)। এই মসজিদে এক রাকাআ’ত নামাজ আদায় করার সাওয়াব মাসজিদুল হারাম (কাবা) ও মাসজিদে নববীতে সালাত আদায়ের পর সবচেয়ে মর্যাদার। এক রাকাত পাঁচশত রাকাতের সমতুল্য। পবিত্র কোরআনে স্বয়ং মহান আল্লাহ এই পবিত্র মসজিদের নাম নিয়ে আলোচনা করছেন। উল্লেখ্য মাসজিদুল আকসা পুরো এই এলাকাটির ব্যাপ্তির নাম (যে রকম মক্কার হারাম শরীফ)। এর অভ্যন্তরে এখন অনেকগুলি আলাদা মাসজিদ আছে। খলীফা উমর রা. ও মারওয়ান রাহি. এর আমলের দুটি মাসজিদ তন্মধ্যে বিখ্যাত। এ বিষয়ে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) বলেছেন- ‘তোমাদের কেউ যদি কোনো খারাপ কাজ বা বিষয় দেখে তাহলে সে যেন হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে দেয়, যদি তা করতে অপারগ হয় তাহলে যেন মুখ দিয়ে তার প্রতিবাদ করে, যদি তাও করতে সক্ষম না হয় তাহলে যেন অন্তর দিয়ে তা ঘৃণা করে, আর এটাই হচ্ছে ঈমানের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলতম স্তর’। 

ইসরায়েলিদের জুলুম-নির্যাতন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তার বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের বাঁচতে শেখা একটি জীবনব্যাপী সংকল্প। মুসলমানদের প্রথম কিবলার মর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে ফিলিস্তিনি শিশুদের যে সাহসী ভূমিকা তা দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হই। আমাদের ধ্বমনীতে ওমর-আলী, সালাহুদ্দীন আইয়ুবী আর আর্তুগ্রুলের রক্ত প্রবাহিত সেটি আমাদের ওই শিশুরাই মনে করিয়ে দেয়। তাই আসুন জেগে উঠি... জায়নবাদীদের জুলুম প্রতিরোধে হাতে নেই নাঙা তলোয়ার। আমি মুসলিম, বীরের জাতি ধ্বনি তুলি বারবার। 

লেখক: সাংবাদিক, কথাশিল্পী। 
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের