শুক্রবার,

২৬ এপ্রিল ২০২৪,

১২ বৈশাখ ১৪৩১

শুক্রবার,

২৬ এপ্রিল ২০২৪,

১২ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

তেঁতুলতলার ভুত

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ০১:৩১, ৩০ এপ্রিল ২০২২

Google News
তেঁতুলতলার ভুত

গ্রামের নাম দুর্গাপুর। একটি পাকা রাস্তাকে ধরে গ্রামটি উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গিয়েছে। আঁটোসাটো বাড়িগুলোর পর বেশকিছু এলাকা ফাঁকা। দিনের বেলায়ও অনেকটা সুনশান থাকে। আর রাতের বেলায় সেই নিরব প্রকৃতিতে নেমে আসে ভৌতিক ছাঁয়া। রাস্তার বাঁ দিকে বাঁশ ঝাড়টা ছাড়িয়ে সরকার বাড়ির পারিবারিক গোরস্থান। সেখানে রয়েছে মস্ত বড় এক তেঁতুল গাছ। গাছের নিচে বেশ খানিকটা যায়গা বিরান। আর তার সামনে বিশাল কান্দর। কান্দরের ওপারে ধুঁধুঁ করা যে গ্রামটি দেখা যায় তার নাম কলন্দা। দিনের বেলায় সেখানে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা খেলা করে। তবে এটি বেশ কিছুদিন আগেকার চিত্র।

বর্তমানে সেখানে কোনো ছেলে-মেয়ে যায় না। রাত তো দূরের কথা দিনের বেলায় গ্রামের বয়স্করাও যেতে ভয় পায়। ভয়ের কারন সেই তেঁতুল গাছে নাকি ভুতে বাসা বেঁধেছে। একদিন ভোর বেলা গ্রামের এতিম ভবঘুরে ছেলে ছাবেদুলকে তেঁতুল তলায় অচেতন অবস্থায় পায় গ্রামবাসী। তারপর থেকে ভুতের ভয় পেয়ে বসেছে ছেলে- মেয়েদের। তেঁতুল তলা এখন বুনো ঝোপঝাড়ে ভরা। এখানে রাতগুলো নামে ভয়ঙ্কর হয়ে। পেঁচা ডাকে। শেয়ালের হুক্কাহুয়া ভেসে যায় দূর থেকে দূরে। কে জানে- জোছনা রাতে জোনাকির সাথে সেখানে পরীদের আসর জমে কি না। কে জানে- রূপালী চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভুতের সাথে কোনো ভুতির প্রেমালাপ জমে কিনা। 

রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার পর আমার দুর্গাপুর গ্রামের এই তেঁতুলতলার গল্পটি মনে পড়ে গেলো। তবে লেখাটি যেহেতু কলাম তাই এখানে গল্পকে আর টেনে লম্বা করলাম না। কোনো গল্পপাগল পাঠক লেখাটি পড়লে যেমন অতৃপ্ত থাকবেন তেমনি আমার নিয়মিত কলাম পাঠকদের কাছেও ভূমিকায় গল্পের অনুপ্রবেশ কিছুটা খটকা সৃষ্টি করতে পারে। তবে পাঠক প্রতিক্রিয়া যাই হোক আজকের লেখায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে তুলে ধরছি। যে বিষয়টিতে ইতোমধ্যে তুমুল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন দেশবাসী। আমার এই লেখাটিও সেই প্রতিক্রিয়ারই অংশ। 

রাজধানী ঢাকা পৃথিবীর বাসঅযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই অযোগ্যতার নানা কারনের মধ্যে একটি শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খোলা যায়গা অর্থাৎ খেলার মাঠ না থাকা। এই বিষয়টি দেশের সবাই জানে। এজন্য সরকারের উঁচু পর্যায় থেকে একজন সাধারণ মানুষেরও আফসোসের কমতি নেই। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের সবার সম্মিলিত এই আফসোসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিনকে দিন অবশিষ্ট যে খোলা যায়গাটুকু রয়েছে সেটিও দখল হচ্ছে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ তেঁতুলতলা খেলার মাঠ দখল করে থানা নির্মাণ কার্যক্রম। 

রাজধানীর মধ্যে তেঁতুলতলা খেলার মাঠটি এতোদিন আমার মতো অনেকের কাছেই অপরিচিত ছিলো। কিন্তু একটি ঘটনা সেই অপরিচিত যায়গাকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি খেলার মাঠে থানা নির্মাণের বিরোধীতা করে একজন সাহসিনী নারী পুলিশের রোষানলে পড়েন। সৈয়দা রতœা নামের ওই ভদ্র মহিলা দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের শৈশব চুরি করা এহেন জঘন্য কাজের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন অনেকটা একা একা। ঘটনার দিন পুলিশের বাঁধার মুখে তিনি ফেসবুক লাইভে গিয়ে পুলিশ কর্তৃক মাঠ দখলের প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেন তার কিশোর ছেলে প্রিয়াংশু। এটি ছিলো একজন সমাজকর্মীর অপরাধ। সেই অপরাধে তাকে টেনেহেঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে  তোলা হয়। তারপর থানায় নিয়ে আটকে রেখে পুলিশি কাজে বাঁধা দেওয়ার অপরাধে মামলা দেওয়া হয়। পাকাপোক্ত করার ব্যবস্থা করা হয় তার বন্দীদশা। এদিকে তার ছেলেকেও আটকানো হয় হাজত খানায়। তবে ছেলের সেই বন্দীদশার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সর্বমহলে। সম্মিলিত প্রতিবাদেও নত হয়নি দখলদাররা। তারা সাহসিনী নারীর দূর্বল যায়গা সন্তানকে জিম্মি করে তার কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করে। তারপর ৮ ঘণ্টার গারদবাসের পর মুক্তি মেলে মা-ছেলের। এর পরের ছবিও দেখা গেছে নেট দুনিয়ায়। ছেলেকে হাজত থেকে মুক্ত করতে পেরে একজন পরাজিত মাও যে সাত-সমুদ্র জয় করতে পারেন সেটিই যেন দেখলো বিশ্ববাসী। কে জানে সৈয়দা রতœার সেই অনুভূতি কেমন ছিলো। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে পুলিশকে মুচলেকা দেওয়ার লজ্জা একবারও তাকে ছুঁয়ে গিয়েছে? শিশুদের খেলার মাঠের জন্য দীর্ঘ লড়াইয়ে ক্লান্ত রতœা  কি মনে মনে বলেছেন ‘পথ দেখিয়ে দিলাম’ এখন তোমাদের পালা-এমন কথা! কি জানি হয়তো বলেছেন, নয়তো বলেননি। 

আমাদের দেশের পুলিশ প্রশাসন এখন একটি দুর্দান্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রীয় সংস্থা। এই সংস্থার ভিত এতোটাই মজবুত যে স্বয়ং সরকারও এই বাহিনীকে তোষামোদ করে চলে। অর্থাৎ পুলিশের মন যুগিয়ে তাদের চলতে হয়। কেন চলতে হয় সেটি অন্য আলোচনা। কলেবর বেড়ে যাবে বলে আজ সেদিকে যাচ্ছি না। তবে এইটুকু বলতে পারি রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী যখন কোনো সরকারের হয়ে কাজ করে তখন সেখানে এই ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের সঙ্গে স্বাতন্ত্র, সাংগঠনিক সম্পর্কের পরিবর্তে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ সম্পর্ক তৈরি হয়। এই উভয় উভয়ের জন্য ধরণের সম্পর্কের কারনে কেউ কাউকে ঘাঁটাতে যায় না। কেউ কাউকে রাগাতে চায় না। এ এক মধুর বন্ধুত্বের সম্পর্ক।

ওই ঘটনার পর তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের একটি সংবাদ দেখেছি। সেখানে থানা নির্মানের জন্য তিনি নতুন করে যায়গা খোজার নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানতে পেরেছি। তবে সেই নির্দেশের কোনো প্রয়োগ হয়েছে বলে দেখিনি। কেননা তেঁতুলতলায় থানা ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়নি। বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতিতে শ্রমিকরা সেখানে ইমারত নির্মানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার পুলিশের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে গণমাধ্যমে। তাতে বলা হয়েছে ওই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য ঢাকা দক্ষিন সিটির মেয়র ব্যরিস্টার শেখ ফজলে নুর তাপসের ডিও লেটারে নাকি ওই যায়গা থানার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যাবতীয় আইন-কানুনন মেনেই নাকি হচ্ছে খেলার মাঠে ভবন নির্মানের কাজ। তাই তারা সৈয়দা রতœা কিংবা এ জাতীয় সমাজকর্মাদের কেন পাত্তা দিবেন? সরকার তাদের দিয়েছে আর তারা নিয়েছে। এই দেওয়া-নেওয়া নিশ্চয়ই আইনানুগ। একটি আইনী বিষয়ের মধ্যে ‘শিশুখেলার’ মত আবেগীয় আবদারের মূল্য কি? খেলার মাঠে দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় হয়তো ছেলেপুলেরা আসবে। সেখানে কিছুটা ছোটাছুটি করে শরীর ময়লা করে তারপর ফিরবে বাসায়। এই গ্যাস-পানি সঙ্কটের শহরে অযথা শরীর, জামা-কাপড় নোংরা করা নিশ্চয়ই কোনো কাজের কাজ নয়। বরং সেটি রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় আর বাসাবাড়িতে মা-বুয়াদের কাজে বাড়তি চাপ বাড়াবে। এইসব বিবেচনায় সেখানে থানা নির্মানই বরং লাভজনক। তবে সেই লাভ কি এবং কিভাবে সেটি সরকার এবং পুলিশ উভয়ের জন্য উইন উইন সিচুয়েশন তৈরি করে সেটি এক্ষণে আর খুলে বলছি না। আশা করি প্রিয় পাঠকের জেহনে সেটি ঢুকবে। 

দুর্গাপুরের তেঁতুলতলায় এখন ছেলে-মেয়েরা খেলতে যায় না। কেননা সেখানে ভুতের বাসা রয়েছে। প্রকান্ড-প্রাচীন গাছটি একদিকে যেমন এলাকার ঐতিহ্য অন্যদিকে সেটি এখন একটি ভুতের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছে। জনাকীর্ণ এই পৃথিবীতে যেখানে মানুষ দিনদিনই ভুতের আবাস কমিয়ে ফেলছে সেখানে এই তেঁতুল গাছ ও গ্রামবাসী নিশ্চয়ই একটি বৃহত সওয়াবের কাজ করছে। কেননা ভুত বা জিনেরাও আল্লাহর মাখলুক। তাদেরও এ পৃথিবীতে বিচরণের অধিকার রয়েছে। রাজধানী ঢাকার তেঁতুলতলায়ও ভুতের আস্তানা হয়েছে। কেননা এখনো আমাদের দেশের মায়েরা ছোটো বাচ্চাদের ভুতের ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়ায়। তাতেও কাজ না হলে দেখায় পুলিশের ভয়। পুলিশের নাম শুনেই ভয়ে ঘুমিয়ে পড়ে অবোধ শিশু। দুর্গাপুরের তেঁতুল গাছের অশরীরী ভুত সেখানকার ছেলে-মেয়েদের অবাধ বিচরণ, হুল্লোড়-আনন্দের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আর ঢাকার শরীরি রূপক ভুতেরা এখানকার অনেক শিশুর বিচরণের দ্বার বন্ধ করে দিচ্ছে। তবে উভয় যায়গায়ই ভুতের বিচরণ চলছে দেদারছে। এই বিচরণে শিশুদের লাভ হোক বা না হোক সরকারের লাভ রয়েছে। 

লেখক: সাংবাদিক ও কথাশিল্পী। 
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের