বৃহস্পতিবার,

২৫ এপ্রিল ২০২৪,

১১ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহস্পতিবার,

২৫ এপ্রিল ২০২৪,

১১ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

এই পদক লইয়া হামজা সাহেব কি করিতেন?  

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ১৮:৩৮, ২৫ মার্চ ২০২২

Google News
এই পদক লইয়া হামজা সাহেব কি করিতেন?  

আমলাতন্ত্র নিয়ে আমাদের দেশে অনেক কথা প্রচলিত আছে। আমাদের স্বাধীনতার বয়স সাকুল্যে ৫০ বছর হলেও আমলাতন্ত্রকে ঘিরে যে প্রবাদ-প্রচলন ইতিমধ্যে সমাজে যে অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে তা রীতিমত বিস্ময়কর। মূলত রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা ও অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে একটি দুর্নীতিপরায়ন আমলাগোষ্ঠী আমাদেরকে গ্রাস করে নিয়েছে। তারাই নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশটাকে। এই নেতৃত্ব কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো নেপথ্যে। তাদের কথা, তাদের সিদ্ধান্তই সাধারণের ভাগ্য। আর তাদের দুর্নীতি ও অসৎ কর্মই যেন আমাদের দুর্ভাগ্য। 

বেশ ক’বছর আগে একটি কাজে গিয়েছিলাম শিক্ষাভবনে। সেখানকার একটা প্রকল্পভিত্তিক কাজে একজনের চাকরির সুপারিশ নিয়ে। বড় কর্তা সাহেব আমার কথাবার্তা শুনে অধীনস্তকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। আমি স্বস্তি অনুভব করলাম। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অধীনস্তের পেছন পেছন তার কক্ষে প্রবেশ করলাম। তিনি আমাকে ওই চাকরির জন্য প্রার্থীর যাবতীয় বৃত্তান্ত জেনে নিলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘ভাই দু:খিত, চাকরিটা হচ্ছে না। কেননা আপনার প্রার্থী এই শর্তটা পূরণ করতে পারছেন না’। আমি পুনরায় তাকে অনুরোধ করে বসলাম। কোনো প্রক্রিয়ায় এটি করা যায় কি না সেটি দেখতে বললাম। লোকটি ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বললেন। টেলিফোনের কথায় যেটি বুঝলাম তা হলো- ওই পোস্টটিতে কোনো এক ডিরেক্টরের প্রার্থী রয়েছেন। তাই সেটি যেন তিনি হাতছাড়া না করেন। অনেকটা অস্পস্ট তবুও কিছুটা বোঝা গেলো ব্যাপারটা। টেলিফোন নামিয়ে মৃদু হেসে লোকটি বললেন, ভাই নিশ্চয়ই ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন। আসলে আপনার প্রার্থীকে হয়তো কোনো না কোনো উপায়ে নেওয়া যেত কিন্তু আমাদের ডিরেক্টর স্যার নাকি সেটি আগেই বলে রেখেছেন। দু:খিত ভাই’। আমি তার কথা শুনে চলে এলাম। মনে মনে ভাবলাম ওনার কোনো দোষ নেই। উনিওতো অধীনস্ত। উনি আর কি করতে পারবেন। 

মাঠ পর্যায়ে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে এমন অনেক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। অনেক দপ্তরে গিয়েছি যেখানে মন্ত্রী ও সচিবের আলাদা আলাদা কোটা রয়েছে। চাকুরি দেন তারা। সেখানে টাকা এবং স্বজন এই দুইটি ক্যাটাগরিই বিদ্যমান। এই দুই ক্যাটাগরিতেই মূলত বণ্টন করা হয় রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। 
গত করোনাকালে এলাকায় দীর্ঘদিন থেকেছি। এই সময়ের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে নানান কিসিমের ভাতা-ভর্তুকি পাওয়ার খবর শুনেছি। অনেককে দেখেছি পুকুর নেই কিন্তু সে মাছ চাষী। কেউ জীবনে গরু পালন করেনি তবে সে করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ খামারি। আবার কেউ মুরগী পালনতো দূরের কথা গন্ধ পর্যন্ত নাকে আসলে অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা সেও মুরগী পালন করে ধরা খাওয়াদের তালিকায় রয়েছে এবং এদের সংখ্যা যে খুব বেশি তা নয়। মূলত এই লোকগুলোই বারবার সব ধরনের ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় থাকে। তারাই বিভিন্ন উপায়ে টাকা নিয়ে নিচ্ছে সরকারী কোষাগারের। বলতে গেলে এমন অনেক ঘটনাই বলা যাবে। লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় সেসবের দিকে যাচ্ছি না। মূলত আমাদের দেশের সুযোগ-সুবিধার একটি বড় অংশই এভাবে মুষ্টিমেয় শ্রেণিতে ঘুরপাক খায়। আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কাছে এখানে প্রকৃত অভাবীরা থেকে যায় সুযোগ বঞ্চিত। যার সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত অখ্যাত গীতিকবি মো. আমির হামজার স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তি। 

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদক পাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। কে এই আমির হামজা, সাহিত্যে কিই বা তার অবদান? সে বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ঘাটাঘাটি শুরু করেন। ঘাটাঘাটি করে তেমন কোনো কীর্তি না পেলেও আমির হামজার বিষয়ে বেশকিছু নেতিবাচক তথ্য বেরিয়ে আসে। তিনি একটি খুনের মামলার আসামি ছিলেন- এই তথ্যটি তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক। এছাড়া বেরিয়ে আসে তার ছেলের পরিচয়ও। যিনি একজন আমলা হিসেবে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালনে রয়েছেন। ছেলের প্রস্তাবে বাবা এই পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন এই তথ্য সামনে আসতে মোটেই দেরি হয়নি। শুরু হয় বিভিন্ন মহলে তুমুল প্রতিক্রিয়া। এতে বিব্রত হয়ে অবশেষে শুক্রবার আমির হামজাকে এই পদক থেকে বাদ দিয়ে সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করে কমিটি। সর্বশেষ রাষ্ট্রীয় পদক প্রদান কমিটির আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, ‘আমির হামজার বিষয়ে যারা ভুল তথ্য দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ওই কাজে নিয়োজিত কয়েকজনকে শো’কজও করা হয়েছে’। মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর বুঝতে বাকি থাকে না যে, এ নিয়ে জনগণের প্রতিক্রিয়ার মাত্রা আসলে কতটা ব্যাপক ছিলো। সেইসঙ্গে সরকারের কানেও কম পানি যায়নি। 

আমির হামজার বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার বরিশাট গ্রামে।  ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান। স্বাধীনতা পদকে নাম আসার আগ পর্যন্ত দেশের কোনো কবি-সাহিত্যিক কিংবা সজ্জন ব্যাক্তি তার নাম শুনেছেন বলে কেউ বলেননি। যে কারনে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বইমেলার মঞ্চ থেকে শুরু করে ফেসবুকের পাতায় নানান শ্রেণি পেশার মানুষ একইসঙ্গে ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এই ক্ষোভ আমির হামজার প্রতি নয়। যারা তাকে পদকের জন্য মনোনীত করেছেন তাদের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি। 

জানা গেছে, স্বাধীনতা পদকের জন্য একটি বাছাই কমিটি রয়েছে। এই কমিটির সদস্য ১৩ জন মন্ত্রী এবং তাদের সঙ্গে রয়েছেন ১০ জন সচিব। এই পদকের জন্য পত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর নির্ধারিত ফরমে নাম প্রস্তাব করতে হয়। সেক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যসহ যে কেউ যে কারো নাম প্রস্তাব করতে পারে। যথাযথ প্রক্রিয়ায় নাম প্রস্তাবের ফরম কমিটির কাছে পৌঁছালে কমিটি সেগুলো যাচাই-বাছাই করে তারপর তালিকা চূড়ান্ত করে থাকে। সেই হিসেবে দায় কোনো ভাবেই মৃত আমির হামজার নয়।  

মো. আমির হামজা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সাহিত্যে তার অবদান কিছু থাকুক বা না থাকুক একটি স্বাধীন দেশের জন্য তার অবদান নি:সন্দেহে ছিলো। তাই তাকে কেউ না চিনলেও তার অবদানকে ছোটো করে দেখার কিছু নেই। তিনি তার পরিচিত গ-িতে নিশ্চয়ই আমির হামজা হিসেবেই ছিলেন মৃত্যুর আগপর্যন্ত। আমি জানি না জীবীত আমির হামজা কোনোদিন স্বাধীনতা পদকের জন্য লালায়িত ছিলেন কি না। কিংবা ছেলের কাছে এ পদকের শান-শওকাত সম্পর্কে শুনে কখনো হাহুতাশ করেছেন কি না। হয়তো করেননি। কেননা একটা নিভৃতপল্লীর পালাগায়ক নিশ্চয়ই তার গ-ি সম্পর্কে জানতেন। নিজের সম্পর্কে মূল্যায়নটা ঠিকঠাক না করতে পারলেও হয়তো এতোটা উচ্চাভিলাসী ছিলেন না। 

তাকে পদকে ভূষিত করার পেছনে তার ছেলে সরকারী কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। কেননা আমলা ছেলে জানেন এই রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা কি করে নিজের করে নিতে হয়। তাই এখানে সর্বোচ্চ কৌশল প্রয়োগ করেছেন তিনি। তাতে ফলও পেয়েছেন। তালিকায় নাম আশার পর নিশ্চয়ই বাবার কথা মনে করে আবেগাপ্লুতও হয়েছেন তিনি। কিংবা সম্ভব হলে বাড়িতে বাবার কবরের পাশে দাড়িয়ে ‘বিশাল অর্জন’ এনে দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করা একজন ছেলে হিসেবে গর্বিতও হয়েছিলেন। কিন্তু শেষমেষ সেটি আর গর্বের বিষয় হয়ে রইলো না। এটি পরিণত হয়েছে ধিক্কারের বিষয়ে। এই ধিক্কারের সবটুকু পড়ছে ছেলে ও বাছাই কমিটি সর্বোপরি দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্রের ঘাড়ে। কোনো বিতর্ক ছাড়া যদি পদকটি টিকেও যেত তাহলেও বা ‘এই পদক লইয়া হামজা সাহেব কি করিতেন’? কেননা তিনি তো দুনিয়ার এইসব তথাকথিত সম্মান-পদকের উর্র্ধ্বে, মহান প্রভূর জিম্মায়। সেখানে এই সবই অর্থহীন। কেবল নেক আমল ছাড়া। 
লেখক: সাংবাদিক, কথশিল্পী। 
 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের