শুক্রবার,

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫,

৪ আশ্বিন ১৪৩২

শুক্রবার,

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫,

৪ আশ্বিন ১৪৩২

Radio Today News

১২০০০ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন করে ময়মনসিংহ

রেডিওটুডে রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১২:০২, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Google News
১২০০০ কোটি টাকার মাছ উৎপাদন করে ময়মনসিংহ

২৬ বছর আগে ১০ একর আয়তনের পুকুরে মাছ চাষ শুরু করেন শাহাবুদ্দিন খান। ময়মনসিংহের ভালুকা পৌরসভার এ বাসিন্দা প্রথম দিকে দেশীয় প্রজাতির মাছ রুই, কাতলা, মৃগেল চাষ করেন। সেখান থেকে প্রতিবছর চার-পাঁচ লাখ টাকা লাভ আসত। 

প্রাথমিক এ সাফল্য শাহাবুদ্দিনকে আরও বড় পরিসরে মাছ চাষে অনুপ্রেরণা জোগায়। এর পর ২০০৭ সালের দিকে পুকুরে পাঙাশ চাষ শুরু করেন, যা ব্যবসায় বড় পরিবর্তন এনে দেয়। বর্তমানে তিনি ১২০ একর খামারের মালিক। সেখানে পাঙাশ ছাড়াও তেলাপিয়া, শিং, মাগুর, ট্যাংরা, গুলশা ও অন্যান্য প্রজাতির মাছের চাষ করছেন।

ময়মনসিংহে শাহাবুদ্দিন খানের মতো এমন প্রায় এক লাখ ২০ হাজার মৎস্য চাষি রয়েছেন, যারা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। এ জেলায় আশির দশকের শেষ দিকে মাছ চাষ বাড়তে থাকে। এর পর ২০১০ সাল থেকে মাছ চাষে প্রায় অর্থবছরেই শীর্ষে থাকে ময়মনসিংহ। বর্তমানে এ জেলায় উৎপাদিত মাছের বাজারমূল্য ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। পুকুর ও খামার রয়েছে প্রায় তিন লাখ। এর মধ্যে এক লাখের বেশি পুকুর ও খামারে বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে। 

ময়মনসিংহ জেলা দেশে মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ মাছ জোগান দেয়। এখান থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাকে শিং, মাগুর, পাঙাশ, তেলাপিয়া, পাবদাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যাচ্ছে সারাদেশে।

সবচেয়ে বেশি মাছ চাষ ময়মনসিংহে

মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ময়মনসিংহ জেলায় মোট মাছ উৎপাদন হয় তিন লাখ ৪৫ হাজার এক টন। কুমিল্লায় তিন লাখ ১৫ হাজার ৪৫৭ টন। তৃতীয় অবস্থানে থাকা যশোরে উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ৪৮ হাজার পাঁচ টন মাছ।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাছ উৎপাদনের পরিমাণ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হয়নি। তবে স্থানীয় মৎস্য দপ্তর জানিয়েছে, ময়মনসিংহে মাছ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ৩৩ হাজার ৪৬০ হেক্টর জলমহাল থেকে মাছ উৎপাদন হয়েছে মোট চার লাখ ১৮ হাজার ৬৪৫ টন। প্রতি কেজি মাছ গড়ে ৩০০ টাকায় বিক্রি হলে এই মাছের বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা।

কুমিল্লা জেলা মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর সূত্র জানায়, এ বছর জেলায় মাছ উৎপাদন হয়েছে তিন লাখ ২৬ হাজার টন। যশোরের আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
ময়মনসিংহের অনেক বেকার যুবক মাছ চাষে ঝুঁকছেন। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ভালুকা ও ত্রিশাল অংশ এবং ময়মনসিংহ-শেরপুর, কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের দুই পাশে মাইলের পর মাইল চোখে পড়বে হাজার হাজার বাণিজ্যিক মাছের খামার।

চাষি শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ‘বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারিনি। ১৯৯৯ সালে অল্প পরিসরে মাছ চাষ শুরু করি। মাছ চাষে সফল হয়েছি। তবে এই সফল যাত্রায় মাঝে মাঝে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। খাবারের দাম বেশি এবং মাছের দাম কম হলে ক্ষতির শিকার হতে হয়। তবুও হাল ছাড়িনি। বরং বিভিন্ন কৌশলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। স্থানীয় মিলে নিজস্ব ফর্মুলায় মানসম্মত খাবার তৈরি করে মাছকে খাওয়াই। এতে উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমার পুকুরগুলো পরিচালনার জন্য বর্তমানে শতাধিক কর্মচারী কাজ করছেন।’

ত্রিশাল পৌরসভার ভাটিপাড়া এলাকার যুবক হুমায়ূন আহমেদের গল্পও প্রেরণামূলক। পড়ালেখা শেষে চাকরির পেছনে না ছুটে তিনি মাছ চাষ শুরু করে সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আনন্দ মোহন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা এ যুবক এখন সফল মৎস্য চাষি। তিনি বছরে প্রায় কোটি টাকা আয় করেন।

হুমায়ূন আহমেদ বলেন, ২০১৯ সালে এক একর আয়তনের পুকুরে শিং মাছ চাষের মাধ্যমে আমার যাত্রা শুরু। প্রথম বছর পরীক্ষামূলক ৬০ হাজার শিং মাছের পোনা ছাড়ি। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে পাঁচ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করি। প্রথম বছরেই শতভাগ লাভ দেখে এই পেশায় আরও মনোযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।

২০২০ সালে পুকুরের আয়তন বাড়িয়ে শিং মাছ চাষ শুরু করলে ভাইরাসের কারণে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হন হুমায়ূন। কিন্তু সে ক্ষতি তাঁকে দমাতে পারেনি। বরং দ্বিগুণ উদ্যমে মাছ চাষ শুরু করেন। হুমায়ূন জানান, পাঙাশ চাষে লাভের পরিমাণ শিং মাছের মতো বেশি না হলেও এতে ঝুঁকি নেই। দুই থেকে তিন মাস অন্তর পুকুরে প্রাকৃতিক উপায়ে চুন ও লবণ ব্যবহার করলে মাছ সুস্থ থাকে। বাজারে প্রস্তুত করা খাবারের দাম বেশি। তাই স্থানীয় ফিড মিল থেকে নিজস্ব ফর্মুলায় খাবার তৈরি করিয়ে নেন। এতে প্রতি কেজি খাবারে খরচ পড়ে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা।

এগিয়ে ভালুকা

জেলা মৎস্য কর্মকর্তারা জানান, মাছ উৎপাদনে ময়মনসিংহ জেলায় প্রথম স্থানে আছে ভালুকা। এ উপজেলায় তিন হাজার ৫৯৬ হেক্টর আয়তনের পুকুরে ৮৩ হাজার ৫৫৩ টন মাছ উৎপাদন হয়। দ্বিতীয় অবস্থানে ত্রিশাল উপজেলা। এখানে তিন হাজার ৬৮৭ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছ উৎপাদন হয় ৭২ হাজার ৮৮ টন। তৃতীয় অবস্থানে থাকা মুক্তাগাছা উপজেলায় দুই হাজার ৮০৪ হেক্টর পুকুরে প্রায় ৪২ হাজার টন মাছ উৎপাদন হয়।

এ ছাড়া ময়মনসিংহ সদর উপজেলায় দুই হাজার ৫০০ হেক্টর পুকুরে বছরে প্রায় ৪০ হাজার টন, তারাকান্দায় দুই হাজার ৪৯৫ হেক্টর পুকুরে ২৯ হাজার টন, নান্দাইলে চার হাজার ১২৮ হেক্টরে ২৮ হাজার ৬৭৩ টন, ফুলবাড়িয়ায় দুই হাজার ৮৪০ হেক্টরে ২৪ হাজার ৩২৫ টন, ঈশ্বরগঞ্জে দুই হাজার ২৭০ হেক্টর পুকুরে ২৪ হাজার ২৮৩ টন, ফুলপুরে দুই হাজার ৩০২ হেক্টরে ২৩ হাজার ৫৬৪ টন, গফরগাঁওয়ে দুই হাজার ৫৮০ হেক্টরে ১৮ হাজার ৭৮৪ টন, গৌরীপুরে এক হাজার ৬৮০ হেক্টরে ১৬ হাজার ৫০০ টন, ধোবাউড়ায় এক হাজার ১৪৮ হেক্টরে সাত হাজার ৪৩১ টন ও হালুয়াঘাটে এক হাজার ৪৩০ হেক্টর পুকুরে আট হাজার ৭০০ টন মাছ উৎপাদন হয়।

বিপুল উৎপাদনেও দুশ্চিন্তা

উৎপাদন বাড়লেও মৎস্য চাষিদের দুশ্চিন্তা কমেনি। মাছের খাদ্যের উচ্চমূল্য, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদহার এবং বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ বিল আদায় হওয়ায় তাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এ ছাড়া আকস্মিক বন্যা এবং মাছের রোগবালাইয়ের কারণে প্রায়ই বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। মাটি, পানি পরীক্ষা ও রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষাগারের অভাবও চাষিদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন সমকালকে বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে চাষিদের অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পুকুরে পানি দেওয়ার জন্য তাদের বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। মাছ চাষিদের জন্য বিদ্যুৎ বিল কৃষকদের মতো সহনীয় পর্যায়ে রাখা উচিত। তা ছাড়া মাছের খাবারের উচ্চ মূল্যের কারণে অনেক কৃষক লাভ করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে চাষিরা যাতে মাছের ন্যায্যমূল্য পান, সেদিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। চাষিদের মূল্যায়ন করলে মাছ উৎপাদন অনেক বাড়ানো যেত।

এ ছাড়া রয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। উৎপাদিত মাছ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে না পারা এবং অনুন্নত বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে অনেক সময় চাষিরা তাদের মাছের ন্যায্যমূল্য পান না। এ বছর জেলায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের আনুমানিক বাজারমূল্য– প্রতি কেজি রুই ৩০০-৪০০, কাতলা ৩৫০-৪০০, মৃগেল ২৫০-৩০০, পাঙাশ ১৮০-২২০, শিং ৩৫০-৪০০, পাবদা ৪০০-৪৫০, গুলশা ৫০০-৫৫০ এবং কৈ ২২০-২৫০ টাকা। এর পরও বাজারমূল্যের কম-বেশি হওয়ায় তাদের মুনাফা কমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক চাষি।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মশিউর রহমান বলেন, মৎস্য খাবার তৈরির জন্য যেসব উপাদান বিদেশ থেকে আনতে হয়, সেগুলো অনেক দামি। এগুলো দেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে আমাদের দেশের প্রতিটি জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় মৎস্য অফিসের পরিচালক নৃপেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ময়মনসিংহের এই সফলতার পেছনে রয়েছে বিশাল জলসম্পদ আর চাষিদের একাগ্রতা। এখানকার প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান মৎস্য চাষের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। আমাদের মূল লক্ষ্য, একটি টেকসই বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। আমরা সরাসরি চাষি থেকে ভোক্তার কাছে মাছ পৌঁছানোর জন্য কার্যকর সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনা করছি। এর ফলে চাষিরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবেন। সেই সঙ্গে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে মাছ রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য কাজ করব। 

রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের