বুধবার,

০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫,

১৯ ভাদ্র ১৪৩২

বুধবার,

০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫,

১৯ ভাদ্র ১৪৩২

Radio Today News

কী ঘটবে, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই ইসরায়েলকে সমর্থন বন্ধ করে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৯:১৬, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

Google News
কী ঘটবে, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই ইসরায়েলকে সমর্থন বন্ধ করে

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধের পুরো সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থনের ওপর ভরসা করতে পেরেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন কখনো কখনো গাজার পরিস্থিতি নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করলেও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন তেমন কোনো দ্বিধা দেখায়নি। বরং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প প্রশাসন গাজার পুরো জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক উৎখাত করার প্রস্তাবও দিয়েছিল।

ইসরায়েলের যুদ্ধযন্ত্রে অস্ত্র সরবরাহসহ যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এর সাহায্যে ইসরায়েল গাজায় ৬৩ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। পাশাপাশি কূটনৈতিকভাবে, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বারবার ভেটো ব্যবহার করে গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবি আটকে দিয়েছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নিহতের সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতেও (আইসিজে) সমর্থন দিয়েছে, যেখানে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।

এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সদস্যদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটি, যারা নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন।
বহু রাষ্ট্র ও সংস্থার চোখে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃত কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য জড়িত থাকার বিষয়টি মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছে এবং ইসরায়েলকে দেওয়া সমর্থন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে।

কিন্তু যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই তা করে? যদি আগামীকালই ইসরায়েলকে দেওয়া সব সমর্থন বন্ধ করে দেয়, তাহলে কী ঘটবে?

এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন চারজন বিশেষজ্ঞ—প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক হামজা আত্তার, ইসরায়েলি রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ওরি গোল্ডবার্গ, রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট ও সেন্টার ফর আমেরিকান প্রগ্রেসের জ্যেষ্ঠ ফেলো এইচ এ হেলিয়ার ও ইসরায়েল সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড্যানিয়েল লেভি।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কী ঘটবে?
ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর অনেকে, যারা প্রথমে ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়েছিল, এখন অসহায় বোধ করছে এবং নিছক ইসরায়েলের পতন দেখতে চাইছে।

অনেকের জন্য, এমনকি জার্মানির ক্ষেত্রেও, যুদ্ধপরবর্তী সেই বন্ধন, যা তাদের ইসরায়েলের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল তা এতটাই দুর্বল হয়ে গেছে যে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এটি সম্ভবত আর টিকে থাকবে না।’
‘আমার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন শেষ হয়ে গেলে সবাই দ্রুত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যাবে, যদিও কেউ প্রথম হতে চাইবে না। আমি নিশ্চিত নই সেটা কী রূপ নেবে—অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা নাকি জাতিসংঘ সনদের অধ্যায় ৭ প্রয়োগ করে সরাসরি হস্তক্ষেপ—তবে এটা খুব দ্রুত ঘটবে।’

আঞ্চলিকভাবে কী ঘটবে? ইসরায়েলের দাবি মতো কি আক্রমণ হবে?
এইচ এ হেলিয়ার বলেন, ‘যদি হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রকে সমীকরণ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে শান্তিপূর্ণ সমাধানের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাও সরানো হবে। আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকায় ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে দোষমুক্ত থেকে কাজ করতে পেরেছে—ফিলিস্তিন, লেবানন বা সিরিয়ার ক্ষেত্রে।

তাই আঞ্চলিক সমন্বয়কে কখনো তারা অগ্রাধিকার দেয়নি।’
‘কিন্তু এই ধারণা যে ইসরায়েল আক্রমণের এক কদম দূরে, সেটা বাস্তব নয় এবং বহু দশক ধরেই তা হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, সিরিয়ার সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের কারণে আক্রমণ থেকে বিরত রয়েছে—ব্যাপারটা এমন নয়; বরং তারা আরো যুদ্ধ চাইছে না বলেই আক্রমণ করছে না। অন্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।’

অর্থনৈতিকভাবে কী ঘটবে?
ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘ইসরায়েল অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল, তবে হঠাৎ করে পুরোপুরি ধসে পড়বে না। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি খাত বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে—আর্থিক সহায়তা, সীমাহীন গবেষণা ও উন্নয়ন—সবই গুরুত্বপূর্ণ।’

তার মতে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কেবল অর্থই দেয় না, ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ধরনের সুরক্ষাও দেয়—ঋণ নিশ্চয়তা ও অন্যান্য সহায়তার মাধ্যমে।

তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি, হঠাৎ এই সমর্থন চলে গেলে প্রথম দিকে খুব বেশি সমস্যা হবে না, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় প্রযুক্তি খাতে ছাঁটাই শুরু হবে এবং সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়বে।’

ইসরায়েলি রাজনীতিতে কী ঘটবে?
ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘আপনি যতটা ভাবছেন, ততটা বড় পরিবর্তন হবে না। ইসরায়েলের বসতি স্থাপনকারীরা নিজেদের ঈশ্বরপ্রদত্ত মিশনে নিয়োজিত হিসেবে বিশ্বাস করে। তারা যেভাবেই হোক চলবে।’

‘নেতানিয়াহু সম্ভবত টিকেও যাবেন। তিনি কোনো জাদুকর নন; বরং যা বলেন ও করেন তা ইসরায়েলি সমাজের বড় অংশের চিন্তার প্রতিফলন। তিনি হয়তো যুক্তি দেখাবেন, গাজায় আক্রমণের কারণ হলো যাতে আমরা আর কোনো রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল না থাকি।’

অন্যদিকে ড্যানিয়েল লেভি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলি ডানপন্থীদের জন্য এক অবিরাম আশীর্বাদ। ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় থাকলে তারা বলে—দেখো, কী সুন্দরভাবে আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। ট্রাম্পের মতো কেউ ক্ষমতায় থাকলে তারা বলে—দেখো, আমরা ঠিক কিছুই করছি, যুক্তরাষ্ট্রও আমাদের সঙ্গে একমত।’

‘ফিলিস্তিনিদের ওপর দমন-পীড়ন চালাতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন তাদের পূর্ণ অব্যাহতি দিয়েছে। অন্য কোনো দেশে হলে এর জন্য রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতো, কিন্তু এখানে তেমন কিছু হয় না।’

সেনাবাহিনীর কী হবে?
হামজা আত্তার বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যদি হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, ইসরায়েল হয়তো এক বছর পর্যন্ত গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। তবে তাদের অগ্রাধিকার পাল্টে যাবে। কারণ তারা উল্লেখযোগ্যভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, তারা ভালোভাবে জানবে, গাজায় একটি গুলি বা বোমা ব্যবহার করা মানে তাদের নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য একটি কমে যাওয়া।’

‘যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট ব্লক করার সুবিধা শেষ হবে, ফলে ইসরায়েলের ভেতরকার তথ্য সহজেই প্রতিপক্ষ দেখতে পারবে। এ ছাড়া আয়রন ডোম বা অ্যারো সিস্টেমের মতো প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অর্থায়নও বন্ধ হয়ে যাবে।’

‘তখন ইসরায়েলকে নতুন অস্ত্র সরবরাহকারীর খোঁজে ইউরোপের ন্যাটো দেশগুলোর দিকে তাকাতে হবে। কিন্তু রাশিয়াকে হুমকি মনে করে ইউরোপ নিজেই অস্ত্র সংকটে রয়েছে, তাই দ্রুত সাহায্য পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বিনা মূল্যে বা ভর্তুকিতে অস্ত্র দেয়, ইউরোপ কিন্তু অর্থ নেবে—যা ইসরায়েলের সাধ্যের বাইরে থাকবে।’

গাজা ও পশ্চিম তীরে কী ঘটবে?
ওরি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘আমার মনে হয়, যখন সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বুঝতে পারবেন কী ঘটছে, তারা অবিলম্বে যুদ্ধ শেষ করার দাবি তুলবেন।’

অন্যদিকে ড্যানিয়েল লেভি মনে করেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সেনাবাহিনী দ্রুতই বুঝবে, তাদের হাতে যুদ্ধ চালানোর মতো অর্থ বা অস্ত্র নেই। এরপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যুদ্ধ চালানো আর সম্ভব হবে না।’

এ ছাড়া এইচ এ হেলিয়ারের অনুমান, ‘তারা গাজা ও পশ্চিম তীরে স্থিতিশীল পরিস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা করবে, সময়ক্ষেপণ করবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক জনমতের দৃষ্টিতে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি একেবারেই তলানিতে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন তাদের প্রকৃত আন্তর্জাতিক জবাবদিহি থেকে রক্ষা করেছে।’

‘যুক্তরাষ্ট্র না থাকলে ইসরায়েলকে একঘরে করে দেওয়া হবে—যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারকে একসময় করা হয়েছিল। তখন দক্ষিণ আফ্রিকার নেতারা বুঝেছিলেন, টিকে থাকার জন্যই পরিবর্তন আনতে হবে।’

রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের