চতুর্থ প্রজন্মের ইউরো ফাইটার টাইফুনকে ঘিরে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষা অঙ্গনে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মাল্টিরোল জঙ্গি বিমানটি তৈরি করে যৌথভাবে ইউরোপের তিন প্রতিষ্ঠান—এয়ারবাস, বিএই সিস্টেমস ও লিওনার্দো। এরই অংশ হিসেবে ইতালির প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো এসপিএর সঙ্গে একটি সম্মতিপত্র সই করেছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, টাইফুন যুদ্ধবিমান কেনার এই প্রক্রিয়া বিমানবাহিনীর সম্মুখ সারির সক্ষমতা বাড়ানোর অংশ। আধুনিক মাল্টি–রোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট হিসেবে টাইফুন যুক্ত হলে আকাশ প্রতিরক্ষায় নতুন শক্তি যোগ হবে।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে যুক্ত হতে যাওয়া নতুন এই যুদ্ধবিমান সম্পর্কে ইউরোফাইটারের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, এটি বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক সুইং-রোল কমব্যাট বিমান।
ইতালির প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো এসপিএর সঙ্গে একটি সম্মতিপত্র সই করেছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী
তারা বলছে, ইউরোফাইটার টাইফুন একইসঙ্গে এয়ার-টু-এয়ার এবং এয়ার-টু-সারফেস সক্ষমতা প্রদান করে এবং একযোগে ব্যবহারযোগ্য।
বিশ্বের ৯টি দেশের বিমান বাহিনীর কাছে এই যুদ্ধবিমান আছে। দেশগুলো হলো যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, অস্ট্রিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান ও কাতার।
ইউরোপের চার শক্তিশালী দেশ যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি ও স্পেনের সহযোগিতায় ইউরোফাইটার টাইফুন কনসোর্টিয়াম গঠিত হয়েছে। তাদের শীর্ষস্থানীয় প্রতিরক্ষা ও অ্যারোস্পেস কোম্পানি এয়ারবাস, বিএই সিস্টেমস ও লিওনার্দো এই যুদ্ধবিমান প্রকল্পের মূল অংশীদার।
ইউরোফাইটার টাইফুন
এটি একটি টুইন-ইঞ্জিন, ক্যানার্ড-ডেল্টা উইং, মাল্টিরোল ফাইটার। ইউরোফাইটারের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এটি পুরোপুরি সুইং-রোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট।
এয়ার-টু-এয়ার দক্ষতা
শত্রু বিমানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টাইফুন তার তীক্ষ্ণ সেন্সর, অসাধারণ গতিবেগ এবং উচ্চমানের ডগফাইটিং ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত। উন্নত রাডার, মিসাইল ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম এর ক্ষিপ্রতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
এয়ার-টু-গ্রাউন্ড আক্রমণ
এটি স্থলভাগে আঘাত হানতেও সমানভাবে সক্ষম। গাইডেড বোমা, প্রিসিশন স্ট্রাইক অস্ত্র এবং রিয়েল-টাইম ব্যাটেলফিল্ড ডেটা প্রক্রিয়াকরণ, সব মিলিয়ে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে এটি ভয়ংকর।
ইন্টেলিজেন্স ও নজরদারি
টাইফুন শুধু যুদ্ধই করে না, এটি তথ্য সংগ্রহ, শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, আর আকাশ প্রতিরক্ষার সামগ্রিক ছবি তৈরিতেও সহায়তা করে।
স্টেলথ বৈশিষ্ট্য
যুদ্ধবিমানটির মোট পৃষ্ঠের মাত্র ১৫ শতাংশ ধাতব, যার ফলে রাডার-নির্ভর সিস্টেমের কাছ থেকে এটি অনেকটাই আড়ালে থাকে। এই নকশা সাবসনিক গতিতে উচ্চমানের ম্যানুভারিং এবং সুপারসনিক গতিতে কার্যকর যুদ্ধক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
হালকা
ইউরোফাইটার টাইফুনের নকশায় শক্তিশালী কিন্তু হালকা কম্পোজিট উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে ঐতিহ্যবাহী উপকরণের তুলনায় এয়ারফ্রেমের ওজন ৩০ শতাংশ কম। এতে রেঞ্জ বৃদ্ধি, পারফরম্যান্স উন্নতি এবং রাডার সিগনেচার হ্রাস—সবই সম্ভব হয়েছে।
ইঞ্জিন
ইউরোফাইটার টাইফুনে বর্তমানে বাজারের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইঞ্জিনগুলোর একটি ইজে২০০ ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে।
জ্বালানি
যুদ্ধবিমানটি সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৬০০ কেজি জ্বালানি বহনে সক্ষম।
অস্ত্র ব্যবস্থা
টাইফুন বিপুল সংখ্যক এয়ার-টু-এয়ার এবং এয়ার-টু-সারফেস অস্ত্র বহন করতে পারে। এটি খুব কাছের ভিজ্যুয়াল রেঞ্জ থেকে শুরু করে অনেক দূরের লং রেঞ্জ এনগেজমেন্ট—উভয় ক্ষেত্রেই কার্যকর।
লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম
টাইফুনের লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম ও এয়ারক্রু ইকুইপমেন্ট অ্যাসেম্বলি সম্পূর্ণ অনন্য। এর মধ্যে রয়েছে—ফুল-কভার অ্যান্টি-জি ট্রাউজার, চেস্ট কাউন্টার-প্রেশার গার্মেন্ট, লিকুইড কন্ডিশনিং গার্মেন্ট, নিউক্লিয়ার, কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল সুরক্ষা।
ইউরোফাইটার টাইফুন মূলত চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হলেও, উন্নত প্রযুক্তি ও আধুনিকীকরণের কারণে একে '৪.৫ প্রজন্ম' বা 'উন্নত চতুর্থ প্রজন্ম' হিসেবেও গণ্য করা হয়। এর নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী যুদ্ধবিমানগুলো হলো ফ্রান্সের দাসো রাফাল, সুইডেনের সাব গ্রিপেন ই/এফ, যুক্তরাষ্ট্রের এফ/এ-১৮ সুপার হর্নেট ও এফ-১৬ ব্লক ৭০/৭২।
সামরিক বিশ্লেষকদের ভাষায়, ইউরো ফাইটার টাইফুন এখনো এমন একটি যুদ্ধবিমান, যা নিজের প্রজন্মের মধ্যে অন্যতম নির্ভরযোগ্য এবং বহুমুখী প্ল্যাটফর্ম। এর গতি, অস্ত্র, সেন্সর ও প্রতিরক্ষা ক্ষমতার সমন্বয় বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যে কৌশলগত মূল্য যোগ করে। যদিও পঞ্চম প্রজন্মের বিমানের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা কঠিন, তবুও আকাশযুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা ও বহুমুখী মিশনে টাইফুন এখনো দেশের আকাশ প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ এক সহায়ক অস্ত্র হিসেবেই বিবেচিত।
উল্লেখ্য, চলতি বছর যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে ২০টি নতুন ইউরোফাইটার টাইফুন কিনতে চুক্তি করেছে তুরস্ক। এজন্য তাদের গুনতে হচ্ছে ৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন পাউন্ড।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

