
চ্যাম্পিয়ন ট্রফি হাতে বাংলাদেশের মেয়েরা
আমাদের দেশে নারীদের কর্মক্ষেত্রে বাধা, পড়ালেখায় বাধা, স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বাধা আর খেলাধুলায় তো রীতিমতো বাধার দেয়াল তৈরি থাকে। এতোসব বাধা ডিঙ্গিয়ে তবু মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সকল প্রতিকূলতা জয় করেও।
দেশের পুরষদের ক্রিকেট কিংবা ফুটবল দুই জায়গাতেই যখন অস্থিরতা চলমান, নেই সাফল্যের দেখা ঠিক সেই সময়টায় দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে পুনরুজ্জীবিত করেছে দেশের নারী ফুটবলাররা। যেনো মরুর বুকে এনে দিয়েছে এক পশলা বৃষ্টি। যেই দেশের সাধারণ মানুষের সাথে মিশে আছে ফুটবল, সেই আবেগে নতুন করে দোলা দিয়েছে আমাদের নারীরা। হ্যাঁ, আমাদের পিছিয়ে পড়া নারীরাই আমাদের পুরো জাতিকে আনন্দে ভাসিয়েছে সাফ চ্যাম্পিয়নশীপের ফাইনালে নেপালকে হারিয়ে।
গতকাল নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নের শিরোপা জিতে বাংলার মেয়েরা। শক্তিশালী নেপালকে হারিয়ে সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা যতোটা কঠিন ছিল এই মেয়েদের জন্য তারচেয়েও বেশি কঠিন ছিল জীবনযুদ্ধে টিকে থেকে খেলা চালিয়ে যাওয়া।
কলসিন্দুরের সাফল্য-
এই জয় কেবল একটি জয়ই নয় বরং এটি ফুটবলে মেয়েদের জাগরণের সাক্ষীও বটে। যেই মেয়েরা আজ আমাদের আনন্দে ভাসিয়েছে, তাদের মধ্যে আটজন আছেন যারা ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত স্কুল কলসিন্দুর থেকে উঠে আসা ফুটবলার। আছে পার্বত্য অঞ্চলের দুর্গম পাহাড় থেকে ওঠে আসা ফুটবলারও। শত বাধার প্রাচীর ডিঙিয়ে এখন দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসে আছেন তারাই। হাজারো বাধা টপকে মেয়েদের এই জাগরণে যদি ফুটবলটা নতুন করে জেগে ওঠে তবেই এই জয়ের সার্থকতা।
ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুরের মতো অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে এসে তারা এখন তারকা ফুটবলার। এই বিজয়যাত্রার পেছনের গল্পটা মোটেও মধুর ছিল না তাদের জন্য।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১১ সালে ঘোষণা দেওয়া হয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট আয়োজনের। ময়মনসিংহ জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উপজেলা ধোবাউড়ার কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজউদ্দিনের খবরটি কানে আসে সেই তথ্যটি। লেগে যান স্কুলের জন্য দল গঠনে। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সানজিদা যোগ দেয় স্কুলের টিমে। এরপর একে একে টিমে নাম লেখায় মারিয়া মান্দা, শিউলি আজিম। তাদের দেখে উৎসাহিত হয়ে যোগ দেয় মারজিয়া আক্তার, শামছুননাহার, তহুরা, সাজেদা, শামছুননাহার জুনিয়র। সেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে যাত্রা শুরু করা এই খেলোয়াড়েরা প্রত্যেকেই এখন জাতীয় দলে।
টিম গঠনের পর কলসিন্দুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজউদ্দিন নিজেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ শুরু করেন।তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল নেন। ২০১২ সালের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে প্রথমবার অংশ নেয় কলসিন্দুর প্রাথামিক বিদ্যালয়। জাতীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হয় সানজিদা, মারিয়া, তহুরারা। চ্যাম্পিয়ন না হতে পারার আক্ষেপ নিয়ে ফিরে আসে তারা। শুরু করে নতুন করে প্রস্তুতি।
অজপাড়া গাঁ কলসিন্দুরের এই মেয়েদের ফুটবল খেলাকে অনেকে তখন ভালো চোখে দেখেনি। পরিবার থেকেও তেমন একটা সহায়তা পায়নি। বিশেষ করে প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে যখন তারা ভর্তি হয়, তখন ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের বাধার মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালে মেয়েদের মধ্যে শারীরিক নানা পরিবর্তন দেখা দেয়। এ সময় তাদের ফুটবল খেলা পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয় লোকজন ভালোভাবে নেয়নি।
তবে লক্ষ্য যাদের অটুট তাদের আর ঠেকায় কে! ২০১৩ সালে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরপরই স্থানীয় প্রশাসন ও ক্রীড়ামোদী ব্যক্তিদের নজরে আসে সানজিদা, মারিয়ারা। সামান্য করে হলেও মিলতে থাকে সুযোগ সুবিধা।
২০১৪ সালের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে মারিয়া মান্দা, শামসুননাহার জুনিয়র। এমন সফলতা দেখে এগিয়ে আসে অন্য মেয়ে শিক্ষার্থীরা।ফুটবলে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার কারণে কলসিন্দুর গ্রামের নামডাক ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। গারো পাহাড়ের সীমান্তবর্তী অবহেলিত এই গ্রামে বিদ্যুৎ আসে ফুটবল কন্যাদের খ্যাতির কারণে। পাকা হয় রাস্তাঘাট। ফুটবল কন্যাদের বদৌলতে সরকারিকরণ হয়েছে কলসিন্দুর স্কুল এন্ড কলেজ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মেয়েদের সংবর্ধনাসহ আর্থিক অনুদানও দিয়েছেন।
উচ্চ মাধ্যমিক শাখার একাদশ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে এই কিশোরীদের গল্প। পাঠ্যবইয়ে 'দ্য আনবিটেন গার্লস' (অপরাজিত মেয়েরা) শিরোনামে একটি বিশেষ পাঠ রাখা হয়েছে।
বয়সভিত্তিক থেকে জাতীয় দল-
মেয়েদের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে থেকে জাতীয় দলে খেলতে নিয়ে আসার জন্য ফুটবল ফেডারেশন কাজ করতে থাকে অনেক আগে থেকে। বর্তমান কোচ গোলাম রব্বানী ২০০৮ সাল থেকেই এঁদের কোচ। কিশোরী ফুটবলারদের ২০১২ সাল থেকে ঢাকায় ফুটবল ফেডারেশন ভবনে রেখে কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়।
অবশ্য তখন কোনো স্পনসর ছিল না।বাফুফের সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন আর ফুটবল ফেডারেশনের নারী কমিটির চেয়ারপারসন মাহফুজা আক্তারের গাঁটের টাকা থেকে এই ব্যয় নির্বাহ করতেন তখন। তিন বছর পরে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ঢাকা ব্যাংক আর ইউনিসেফ।
অনূর্ধ্ব ১৩, ১৪-এর সেই মেয়েরা মা–বাবা ও গ্রাম ছেড়ে এসে একাগ্র সাধনা করছেন, নিচ্ছেন পরিকল্পিত প্রশিক্ষণ। করছেন কঠোর পরিশ্রম। একসঙ্গে হেসেখেলে একটা অভিন্ন আত্মার দল হয়ে উঠেছেন। মেয়েদের ফুটবল টিমের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি, যুক্তরাজ্য থেকে এসেছেন। আর কোচ হিসেবে আছেন গোলাম রব্বানী।
মেয়েরা এবারের সাফ টুর্নামেন্টে একটা করে খেলা জিতেছেন, আর জয়ের কৃতিত্ব দিয়েছেন কোচকে। ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে এই টিম একসঙ্গে থাকছে, প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, খেলছে। মতিঝিলের বাফুফে ভবনের চারতলা তাঁদের আবাস।
সাফ জয় করা এই দলে কলসিন্দুর গ্রামের মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র ও জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তার আছেন। সিরাত জাহান স্বপ্নার বাড়ি রংপুর। আঁখির বাড়ি সিরাজগঞ্জ। অধিনায়ক সাবিনা, এরই মধ্যে দুটি হ্যাটট্রিক যাঁর এই টুর্নামেন্টে এবং মাসুরা সাতক্ষীরার মেয়ে। কৃষ্ণা টাঙ্গাইলের, মনিকা আর রুপনা রাঙামাটির। আনাই আর আনচিং যমজ বোন খাগড়াছড়ির। নীলুফার ইয়াসমিন কুষ্টিয়ার।
অজপাড়াগাঁ কিংবা পাহাড়ি প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা মেয়েরাই আজ বাংলাদেশের ফুটবল প্রেমিদের মন জিতে নিয়েছে। তাদের সাফল্যে দেশের সবার আনন্দ মিশে একাকার। এই আনন্দের ধারা বয়ে চলুক, চলতেই থাকুক। যে ধারায় হয়তো একদিন বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ট্রফি হাতে তুলবে এই স্বর্ণকন্যারা।