মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা শোষণ, দুর্ব্যবহার ও প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। তারা সতর্ক করেছেন, দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিকরা পদ্ধতিগতভাবে এসব অন্যায্য আচরণ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি তারা ঋণের জালে আটকে যাওয়ার মতো ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিতে রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) ওয়েবসাইটে বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত হওয়ায় মালয়েশিয়ায় অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক মানবেতর জীবন পার করছেন। অনেককে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুয়া নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে। দেশটিতে কাজে যাওয়ার পর চুক্তি অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র না মেলায় চরম ভোগান্তির শিকার হন শ্রমিকরা। তাছাড়া সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার নজরদারির অভাবে এসব শ্রমিকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
মালয়েশিয়ায় বিশাল সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করেন। বর্তমানে আট লাখের বেশি বাংলাদেশির কাজের অনুমোদন রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, অনেক শ্রমিককে নির্ধারিত সরকারি হারের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ফি পরিশোধ করতে হয়েছে। এর পরও হয় তারা যেতে পারেননি, কিংবা মালয়েশিয়ায় গিয়ে চরম শোষণের মুখে পড়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, যেসব শ্রমিকের সঠিক নথিপত্র নেই, তারা গ্রেপ্তার বা আটক, অমানবিক আচরণ ও বিতাড়নের ঝুঁকিতে থাকেন। মালয়েশিয়ার কঠোর অভিবাসী আইনে যে কোনো অনুপ্রবেশকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ জন্য দেশটিতে নিয়মিত ধরপাকড় অভিযান চলছে। অভিবাসন আটককেন্দ্রে বর্তমানে প্রায় ১৮ হাজার অভিবাসী শ্রমিক, শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীকে রাখা হয়েছে।
এর আগে মালয়েশিয়ার কয়েকটি কারখানার বিরুদ্ধে আমদানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। জবরদস্তিমূলক শ্রম প্রয়োগের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘ফোর্সড লেবার রেগুলেশন’ প্রয়োগ নীতি রয়েছে, যা ২০২৭ সালে কার্যকর হবে। শ্রমিকদের ঋণের ফাঁদে জড়ানো ও প্রতারণার ঘটনায় এই বিধির আওতায় আনা হতে পারে।
বাংলাদেশ, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য শ্রমিক আদান-প্রদানকারী দেশ শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে অবস্থিত ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোও একই নীতির আওতাভুক্ত।
জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের আহ্বান অনুযায়ী, শ্রমিক পাঠানো দেশগুলোকে অবশ্যই অভিযোগগুলো দ্রুত তদন্ত করে কার্যকর প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা জোর দেন, প্রত্যাবাসন বা কোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের লঙ্ঘন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, মালয়েশিয়া থেকে পণ্য কেনে এমন আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের ‘ফেয়ার লেবার অ্যাসোসিয়েশন’-এর দাপ্তরিক নির্দেশিকা অনুসরণ করা উচিত। ওই নির্দেশিকায় ক্রেতাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তারা নিয়োগ ব্যয়কে তাদের ক্রয় মানদণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেন। সরবরাহকারীরা যেন বাণিজ্যিক নথি প্রস্তুত করার সময় এসব ব্যয় যুক্ত করেন। শ্রমিকদের জন্য আইনি সহায়তা নিশ্চিত করতেও ক্রেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, অভিবাসী শ্রমিকের শ্রমের ওপর যেসব দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল, দেশগুলোর আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে আরও নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি বাড়বে এবং হাজারো শ্রমিকের দুর্ভোগ দীর্ঘায়িত হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার উচিত শ্রমিকদের প্রতি দুর্ব্যবহার বন্ধ করা। তাদের শ্রম থেকে যেসব দেশের অর্থনীতি লাভবান হয়, তাদের সবার উচিত আরও নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি এড়ানো। তাছাড়া হাজার হাজার মানুষের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এমন কর্মকাণ্ড বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়াও জরুরি।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

