
গোপালগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে মোট ১১টি পয়েন্টে গোপালগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিস্তারিত জানানো হয়েছে। পাঠকদের জন্য পুলিশের প্রতিবেদনটি উল্লেখ করা হলো।
এক. ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে স্মরণ করতে এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া মানুষের কথা শুনতে ১-৩০ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে মাসব্যাপী ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি ঘোষণা করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১৬ জুলাই ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ কর্মসূচিতে সকাল ১১টায় গোপালগঞ্জ পৌর উন্মুক্ত মঞ্চে জাতীয় নাগরিক পার্টি এক জনসমাবেশ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়। ওই সমাবেশে অংশ নেওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরিশাল মহানগরীর সদর থানার সার্কিট হাউস এলাকা থেকে দলের কেন্দ্রীয় নেতা নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেন, হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, শামান্তা শারমিন, তাসনিম জারা, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ রওনা দেন।
দুই. সমাবেশের নিরাপত্তা জন্য সকাল থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন তৎপর থাকে।
সকাল সাড়ে ৯টায় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের একটি সন্ত্রাসী দল গোপালগঞ্জ সদর থানার উলপুরে আইন-শৃঙ্খলা ডিউটিতে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা করে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় একজন পুলিশ পরিদর্শকসহ ৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হন।
তিন. সকাল ১১টায় গোপালগঞ্জ সদর থানার কংশুর বাসস্ট্যান্ডে গোপালগঞ্জ-টেকেরহাট সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ওমর ফারুক খান রিপনের নেতৃত্বে ৪০-৫০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থকরা সড়কে গাছ ফেলে এবং কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় গোপালগঞ্জ ইএনওর গাড়ি ওই স্থানে গেলে গাড়ি ভাঙচুর করে সড়ক অবরোধ করে রাখে তারা।
চার. সকাল সাড়ে ১১টায় কোটালীপাড়া থানার অবদার হাট এলাকায় কোটালীপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমের নেতৃত্বে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল করে কোটালীপাড়া-পয়সারহাট সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে ২৮০০-৩০০০ নেতাকর্মী রাস্তা অবরোধ করে রাখে। সকাল ১১টা ৪০ ঘটিকায় গোপালগঞ্জ সদর থানার কাঠি বাজার এলাকায় গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের গোপালগঞ্জ পৌরসভার মামুনের নেতৃত্বে ২০০-৩০০ জন আওয়ামী লীগ সমর্থক দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করে।
পাঁচ. জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃবৃন্দ গোপালগঞ্জ পৌরপার্ক সভাস্থলে পৌঁছানোর পূর্বে দুপুর আনুমানিক ১টা ৪০ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ৫০-৬০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল ককটেল বিস্ফোরণ করে ঢাল, দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মঞ্চে আক্রমণ করেন। তারা মঞ্চের ব্যানার এবং চেয়ার ভাঙচুর করেন। দুপুর ২টায় এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মঞ্চে উঠেন।
ছয়. ইতিমধ্যে দুপুর সোয়া ২টার দিকে গোপালগঞ্জ সদর থানার সাতপাড় বাজার এলাকায় দুর্বৃত্তরা দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করে। উচ্ছৃঙ্খল জনগণ রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড দেয় এবং বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগ করে।
সাত. বিকেল পৌনে ৩টার দিকে পদযাত্রা সভা শেষ করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সভাস্থল ত্যাগ করেন। ওই পদযাত্রা সভায় আনুমানিক ২০০ জন লোক উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে তাদের গাড়ি বহর পরবর্তী পদযাত্রা সভাস্থল মাদারীপুরের উদ্দেশে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর প্রহরায় রওনা দিলে গোপালগঞ্জ পৌরসভার লঞ্চঘাটে আওয়ামী লীগ ও এর নিষিদ্ধ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৩টার দিকে গাড়িবহর আটকে দেয়।
আট. সেনাবাহিনী ও পুলিশ উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ এনসিপির নেতা কর্মীদের ওপর আক্রমণ করে। এ ছাড়া নাশকতাকারীরা গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারসহ অন্য সরকারি স্থাপনায় হামলা করে। এ সময় সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। ওই ঘটনায় প্রায় ৪৫ জন পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকসহ প্রায় অর্ধশতাধিক লোকজন আহত হয় বলে জানা যায়।
নয়. নাশকতাকারীদের আক্রমণের ফলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ এনসিপি নেতাকর্মীদের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নিরাপদে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে বিকেল ৫টার দিকে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে যৌথ বাহিনীর সহায়তায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃবৃন্দ গাড়িতে করে বাগেরহাট হয়ে খুলনার উদ্দেশে চলে যান।
দশ. রাত আনুমানিক সাড়ে ৭টার দিকে উচ্ছৃঙ্খল জনতা নিহত ৪ জনের মরদেহ পোস্টমর্টেম করতে না দিয়ে জেলা হাসপাতাল থেকে জোরপূর্বক নিয়ে যায়।
এগারো. এখন পর্যন্ত যৌথবাহিনী ও পুলিশ নাশকতার ঘটনার সাথে জড়িত ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বর্তমানে গোপালগঞ্জ জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার্থে ১৫০৭ জন পুলিশ সদস্যসহ সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন আজ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে বর্তমান পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ রয়েছে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম