
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৫০ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশিকে ভোটার করার লক্ষ্য নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিশ্বের ৪০টি দেশের ১ কোটি ৪০ লাখ প্রবাসীর মধ্যে এই সংখ্যক ব্যক্তিকে ভোটদানের সুযোগ করে দিতে চায় তারা।
এই ৫০ লাখ প্রবাসী ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে কত খরচ করতে হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি কর্মকর্তারা জানান, প্রবাসীরা এবার অনলাইনে নিবন্ধন করে ভোট দেবেন। নিবন্ধনের জন্য তৈরি করা হচ্ছে ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামে একটি অ্যাপ। এজন্য প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি টাকা। এছাড়া ৫০ লাখ প্রবাসী ভোটারের পোস্টাল ব্যালটে ভোট নিতে ভোটার প্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০০ টাকা। প্রতি লাখে ৭ কোটি হিসেবে মোট ৩৫০ কোটি টাকা। এই টাকা পোস্টাল ব্যালট পেপার প্রবাসীদের কাছে ডাকযোগে পাঠানো, আবার আনাসহ অন্যান্য কাজে ব্যয় হবে। ফলে প্রবাসী ভোটারদের ভোট গ্রহণের পুরো প্রক্রিয়া সারতে সব মিলিয়ে ব্যয় হচ্ছে ৪০০ কোটি টাকা।
এর আগে প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণেই প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নির্বাচন কমিশনও সে মোতাবেক প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। এক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হলেও রাজনৈতিক দলগুলো থেকে পোস্টাল ব্যালটের প্রতি আগ্রহের কথা ওঠে আসে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আইটি বেইজড পোস্টাল ব্যালটে ভোট ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে সংস্থাটি। প্রবাসীরা ছাড়াও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এবং আইনি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিরা পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এতে প্রথমবারের মতো দেশের ৭১টি কারাগারের বন্দিরা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, পরীক্ষামূলক বা সীমিত পরিসরে হলেও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই কমিশন প্রবাসীদের ভোটের সুযোগ সৃষ্টি করতে চায়। এজন্য প্রবাসীদের ভোটার করার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা হয়েছে।
ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, বিভিন্ন দেশে ঠিক কত সংখ্যক প্রবাসী রয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর সঙ্গে আমরা কথা বলে জেনেছি ১ কোটি ৪০ লাখের মতো প্রবাসী রয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ বাংলাদেশির এনআইডি আছে। সেই হিসেবে ৫০ লাখের মতো ভোটারকে এবারের ভোটে পাবো বলে আশা করছি। যদিও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে প্রবাসী ভোটের হার ২০ থেকে ২২ শতাংশের মতো হয়।
বিভিন্ন দেশে কত প্রবাসী
নির্বাচন কমিশন- প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনশক্তি ব্যুরো, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি-বায়রাসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে ৪০টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীদের আধিক্য রয়েছে এসব দেশকে মাথায় রেখে প্রবাসী ভোট কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
দেশগুলো হলো- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সুদান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি, হংকং, মিশর, ব্রুনাই, মরিশাস, ইরাক, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, স্পেন, জার্মানি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিল, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, তুরস্ক ও সাইপ্রাস। এসব দেশে এক কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ জন প্রবাসী রয়েছে। এদের মধ্যে ৭০ শতাংশের মতো ভোটারের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) আছে বলে ধারণা করছে ইসি। যাদের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্রবাসী ভোটারের সাড়া পাবে বলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রবাসীদের ভোটদানের প্রক্রিয়া
প্রবাসীদের ভোট দেওয়ার জন্য অনলাইন নিবন্ধনের অ্যাপটি নভেম্বরে তৈরি করে ফেলবে ইসি। এরপরেই প্রবাসীদের নিবন্ধনের জন্য প্রচারণা চালানো হবে। এক্ষেত্রে তারা ওই অ্যাপের মাধ্যমে নিজের এনআইডি নম্বর, বর্তমান ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করবেন।
এভাবে যারা নিবন্ধন করবেন তাদের জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় প্রবাসীদের পৃথক ভোটার তালিকা করা হবে। তপশিল ঘোষণার পর সেই তালিকা অনুযায়ী পোস্টাল ব্যালট ছাপানো হবে। যে ব্যালটে শুধু দলগুলোর মার্কা তথা প্রতীক থাকবে। কোনো প্রার্থীর নাম থাকবে না। কারণ প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার আগে কারো নাম ব্যালটে ছাপানো যায় না। আর প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর ব্যালট পাঠানোর সময় কুলোবে না। আবার মামলার রায়ে কেউ প্রার্থিতা পেলে নতুন করে ব্যালট ছাপাতে হবে। তাই আগেই প্রার্থীর নাম ব্যতীত 'সিম্বল ব্যালট' ছাপানো হবে। সেই ব্যালট প্রবাসীর দেওয়া ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে ডাক বিভাগের মাধ্যমে।
এদিকে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে প্রার্থিতা চূড়ান্ত হলে অনলাইনে নিবন্ধনকারীর মোবাইলে মেসেজ দিয়ে এলাকার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা দেখে পছন্দের প্রার্থীর প্রতীকে ভোট দিতে বলা হবে। সেই মেসেজ পেয়ে প্রবাসী ভোটার তার ভোটটি দিয়ে ডাক যোগে পাঠাবেন।
দেশে ভোটের তারিখের অন্তত ২০ দিন আগে একজন প্রবাসী ভোট দেবেন। এক্ষেত্রে ভোটার যে বর্তমান ঠিকানায় নিবন্ধন করেছেন, সেই ঠিকানায় একটি খামে একটি ব্যালট পেপার এবং আরো দুটি খাম যাবে। আর ভেতরে থাকা একটি খামে আসন ও রিটার্নিং কর্মকর্তার ঠিকানা থাকবে। ভোটার কলম দিয়ে নির্ধারিত উপায়ে ব্যালট পেপারে তার ভোট দিয়ে তা আবার রিটার্নিং কর্মকর্তার ঠিকানা লেখা খামে ভরে ডাকযোগে পাঠিয়ে দেবেন। তবে প্রবাসীরা আগেই ভোট দিলেও সেই ভোট জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে জমা থাকবে। ভোটের দিন সেগুলো সংশ্লিষ্ট আসনে দেশের ভোটের সঙ্গে গণনা করা হবে।
পোস্টাল ব্যালট পাঠানো থেকে শুরু করে ফেরত আনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে সরকারি ডাক বিভাগের মাধ্যমে। ডাক বিভাগ জানিয়েছে সবচেয়ে দূরের দেশে একটি চিঠি পাঠাতে এবং আনতে ২৮ দিন লাগে। তাই দেশের ভোটারদের আগেই প্রবাসী ভোটাররা ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। এজন্য দেশে-বিদেশে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারও চালানো হবে।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানান, যেসব প্রবাসী ভোটারের এনআইডি আছে তারাই কেবল এই সুযোগ পাবেন। কারণ এনআইডি ছাড়া নিবন্ধন করার সুযোগ থাকবে না।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম