
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ এবং সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রিয়াদে ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ (এসএমডিএ) স্বাক্ষর করেছেন। অনুষ্ঠানে শাহবাজকে সৌদি এফ-১৫ যুদ্ধবিমানের অভিবাদন, লালগালিচা সংবর্ধনা এবং পূর্ণ রাজকীয় প্রটোকলের মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সৌদি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাক্ষরের সময় শাহবাজ শরিফ হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রায় আট দশক ধরে চলা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। চুক্তি স্বাক্ষরের সময়পর্বটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির। দুই বছর ধরে গাজায় ইসরায়েলের হামলা চলছিল, পাশাপাশি প্রতিবেশী কয়েকটি দেশেও আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি কাতারে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
চুক্তির প্রেক্ষাপট হিসেবে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে চলমান উত্তেজনাও গুরুত্বপূর্ণ। চলতি বছরের মে মাসে দুই দেশের মধ্যে চার দিনের তীব্র সংঘাত ঘটেছিল, যেখানে একে অপরের সামরিক ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানো হয়। এতে দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে প্রবেশের প্রান্তে পৌঁছে যায়।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চুক্তি দুই দেশের নিরাপত্তা জোরদার এবং আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় যৌথ প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। চুক্তিতে বলা হয়েছে, যেকোনো একটি দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে গণ্য হবে।
ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক স্টিমসন সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ফেলো আসফান্দিয়ার মীর এই চুক্তিকে দুই দেশের জন্য ‘মাইলফলক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি বজায় রেখেছিল, তবে সত্তরের দশকে তা ভেঙে পড়েছিল। চীনের সঙ্গে বিস্তৃত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক কোনো পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল না।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক নিরাপত্তা গবেষক মুহাম্মদ ফয়সাল বলেন, চুক্তি পাকিস্তানের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কাতারের মতো উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতার মডেল হতে পারে। তিনি বলেন, এটি চলমান বহুমুখী প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে আনুষ্ঠানিক ও শক্তিশালী করবে, যৌথ প্রশিক্ষণ, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন এবং সৌদি আরবে পাকিস্তানি সেনা মোতায়েনের নতুন সুযোগ তৈরি করবে।
ঐতিহাসিকভাবে, পাকিস্তান স্বাধীনতার পর ১৯৪৭ সালে সৌদি আরব প্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৫১ সালে দুই দেশ বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা কৌশলগত, রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করে। পাকিস্তানি সেনারা বহুবার সৌদি আরবে মোতায়েন হয়েছেন এবং সৌদি সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ৮,০০০-এর বেশি সৌদি সেনা পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ১৯৮২ সালের চুক্তি এই সহযোগিতাকে আরও সুদৃঢ় করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও ক্রমশ পরিবর্তনশীল। গাজায় ইসরায়েলের হামলা এবং প্রতিবেশী দেশে আক্রমণের কারণে উপসাগরীয় দেশগুলো অস্থির। যুক্তরাষ্ট্র এখনও এই দেশগুলোর প্রধান নিরাপত্তা আশ্রয়, যদিও তারা ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
স্বাধীন বিশ্লেষক সাহার খান বলেন, চুক্তির ভাষা যুক্তরাষ্ট্রে প্রশ্ন তুলতে পারে। গত চার বছরে জো বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর সাতবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তাদের উদ্বেগের বিষয় ছিল পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক কর্মসূচি। তবে পাকিস্তান স্পষ্ট করেছে, চুক্তি মূলত ভারত-কেন্দ্রিক এবং সৌদি যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়াবে না।
চুক্তিতে কোনো পারমাণবিক ছাতা বা বর্ধিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ইঙ্গিত নেই। তবে রাজনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সমন্বয় আরও গভীর হবে এবং উভয় দেশের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। চুক্তিতে বলা হয়েছে, এক দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসনকে উভয়ের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হিসেবে গণ্য করা হবে; এটি আপাতত রাজনৈতিক বার্তা হলেও ভবিষ্যতে জোটের কার্যকারিতা বাড়াবে।
ফলস্বরূপ, পাকিস্তান-সৌদি চুক্তি উভয় দেশের জন্য কৌশলগত ও রাজনৈতিকভাবে একটি বড় পদক্ষেপ, যা আঞ্চলিক নিরাপত্তা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতিতে নতুন দিকনির্দেশনা যোগ করবে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম