বুধবার,

০৮ মে ২০২৪,

২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বুধবার,

০৮ মে ২০২৪,

২৫ বৈশাখ ১৪৩১

Radio Today News

অটোপাসে ক্লাস বেড়েছে মগজ বাড়েনি

মেসবাহ শিমুল, সাংবাদিক 

প্রকাশিত: ১৮:৫৩, ১১ মার্চ ২০২২

Google News
অটোপাসে ক্লাস বেড়েছে মগজ বাড়েনি

দেশীয় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে কোনোকিছু বলার নেই। কেননা এ নিয়ে বলার এবং শোনার যথেষ্ট লোক আছে। আমাদের নাগরিক জীবনে যতটুকু বেদনার তার সবটুকু আমাদের নিজস্ব। আর যতটুকু আনন্দ-উল্লাসের সেখানে অনেকেরই ভাগ রয়েছে। এই ভাগ কখনো কেই জোর কওে আদায় করে নেয়। আবার কখনো তা এমনিতেই বণ্টন হয়ে যায়। আজকের লেখায় তেমন কিছু আনন্দ ভাগ করে নিতে চাই। 

ভর দুপুরে সেই যে ট্রেনে চেপে বসেছি, সেটি কেবল ছুটছেই। চলার পথে কতশত ঘরদ্বোর, গ্রাম-জনপদ, অবারিত ফসলের মাঠ মাড়িয়ে চলে। এই ফাগুন মাসে সবুজ ধানের মাঠে দিগন্ত জোড়া মেলবন্ধন। শিমুলের রক্তরঙা ডাল আর অসংখ্য স্থানের বৈচিত্রময় স্থাপণা চোখে পড়ে। এর সবটুকু মানসপটে ধরে রাখা যায় না। অথচ শেষ বিকেলে এসে ট্রেনের জানালায় বসে কত কি যে মনে আসে। সমাজ, সংসার কিংবা রাষ্ট্র সবকিছুই যেন বিক্ষিপ্ত। কোথাও কোনো পরিপাটি সাজানো ছবি নেই। এই এলোমেলো ক্যানভাসে শিশুদের কোলাহল, যুবক-যুবতীদের কলহাস্য কিংবা প্রৌড়ের বিলাপ কোনো কিছুতেই যেন ঠিক মন বসে না। এটাই নিয়ম। অনেক কিছু দেখেও যেন কিছুই দেখা হয় না। অনেক কিছু শুনে যেন কিছুই আটকে না মগজে। এই থাকা না থাকার যে দোলাচল তাতে কি কেবলই আমাদের মস্তিস্ক দায়ী? নাকি এর পেছনে আমাদের পারিপার্শি¦ক পরিবেশও ভূমিকা রাখে- এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই কারো না কারো কাছে পাওয়া যাবে। তবে এইখানে এর জবাব পাওয়াটা জরুরি নয়। 

আমার অর্ধাঙ্গী সরকারি প্রাইমারী স্কুলের একজন একনিষ্ঠ শিক্ষিকা। করোনার দীর্ঘ ছুটি শেষে সম্প্রতি পাঠদানে ফিরেছে। প্রথম দিন ক্লাস থেকে ফিরে হতাশার কথা শোনালো সে। জানালো পঞ্চম শ্রেণিতে জনা পঁচিশেক শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২ জন ক্লাসে ফিরেছে। এর মধ্যে ২ জন মোটামুটি বাংলা-ইংরেজি দেখে পড়তে পারে। অবশিষ্ট দশজনের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। দেখে পড়তে পারে না। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। আশঙ্কা, এদের এই অবস্থা থেকে উত্তোরণে কোনো পথ আছে কি না সেটি তার জানা নেই। করোনার এই সময়ে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা অটোপাশ করে ক্লাসে উঠে গেছে। কিন্তু তাদের মানসিক গ্রোথ হয়নি। পড়াশুনা অটো এগোয়নি। এদের ভবিষ্যত কি হবে? কিভাবে পুষবে এই ঘাটতি? 

আমার ছোটো বোনের মেয়ে। ক্লাস সিক্সে উঠেছে এবার। মাঝখানে দুইটি ক্লাসে অটোপাস। চিকিৎসার জন্য মাঝে মাঝে ঢাকা আসে। খুবই ঠোঁটকাটা স্বভাব। কথা একদম আটকায় না। এবার বাসায় এসে স্কুলের পড়াশুনা নিয়ে বেশ অভিযোগ শোনালো। সেইসঙ্গে স্কুলের শিক্ষকদের কথাও। ওর বাবাও ওই স্কুলের শিক্ষক। তাতে কি, স্কুলের দোষ বলতে মুখে আটকায় না নাবিলার। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং একইসঙ্গে হাস্যকর কথা শোনালো সে ‘বই দেখলি এহন মাথা ঘোরে। দুই বছর স্কুলে না যাতি যাতি এহন স্কুলের ক্লাসরুম মনে অয় সবচাইতে খারাপ যাগা’। সত্যিই নাবিলার অনুভূতি প্রকাশের কথাগুলো খোলামেলা কিন্তু দারুণ। তার মুখ থেকে একটা কঠিন বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে পারলাম। এই অবস্থা যে কেবল ওর সেটি নিশ্চয়ই নয়। এমন পরিস্থিতি সারাদেশে প্রায় সব শিক্ষার্থীর। বিশেষ করে প্রাইমারী থেকে হাইস্কুল পর্যন্ত। 

রাজধানীতে বই মেলা চলছে। বাবার সঙ্গে মেলা ঘুরে এসে নাবিলার পর্যবেক্ষণ ‘মেলায় অনেক লোক কিন্তু বেডারা খালি মোবাইল নিয়া ব্যস্ত। খালি ছবি তোলে আর আড্ডা দেয়। বইমেলা না অইয়া মোবাইল মেলা নাম দিলিই ভালো হতো’। কি দারুণ পর্যবেক্ষণ। কি নিখুঁত বর্ণনা। আমি ভাবি আসলেই তাই। বই মেলায় দেদারছে মানুষ যাচ্ছে। লেখকের ছড়াছড়ি। কিন্তু সে তুলনায় বইয়ের বিক্রি কি হচ্ছে। হলেও নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শতকরা কতভাগ বই কিনছে কিংবা কিনে পড়ছে?

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অনেক ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে। তবে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হলো শিক্ষাঙ্গণ থেকে শিক্ষার বিলুপ্তি। বিশেষ করে মূল বই থেকে শিক্ষার প্রবণতা এবং জ্ঞানার্জনের জন্য বই পড়া দুটোই কমেছে আমাদের দেশে। 

গত দুই বছর করোনার কারনে দেশের শিক্ষাঙ্গণে অটোপাস দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এখানে সরকারের হয়তো কিছু করার ছিলো না। কিন্তু এই অটোপাস আমাদের শিশুদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। বিশেষ করে তারা এখন বই ভয় পায়। শ্রেণি কক্ষে ফিরলেও তারা বেসিক বই ঘাটতে ভয় পাচ্ছে। শিক্ষকরা বলছেন, দুটি বছর বিশেষ করে গ্রামের একটি বিশাল শ্রেণির ছেলে-মেয়েরা বই থেকে দূরে সরে গেছে। এখন তাদের বইমুখী করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ। প্রথমত তাদের ক্লাসে ফেরাতে হবে। তারপর তাদের পাঠে ফিরিয়ে আনতে হবে। অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ে ইংরেজিতে নিজের নাম, স্কুলের নাম লিখতে ভুলে গেছে। এই অবস্থা থেকে স্বাভাবিক করতে কতদিন সময় লাগবে সেটি তারা বুঝতে পারছেন না।

আমার স্ত্রীর ছোটো বোনের একটি ছাগল রয়েছে। ছোটো বেলায় মা মারা যাওয়ার কারনে খুব আদরযতেœ ছাগল ছানাটিকে বড় করেছে সে। নাম দিয়েছে টাইগার। এখন এই টাইগারই তার অবসর সময়ের সঙ্গী। শিক্ষকতা পেশায় থাকলেও গেল দু’বছর অলস সময়ে ছাগলটিই তার বন্ধু হয়ে যায়। তারসঙ্গে ঘুমায়। বিছানায় উঠে খেলা করে। এমনকী শুয়ে শুয়ে বই পড়লে ছাগলটি তার পাশে বসে থাকে। যেন সেও পড়ছে। কিংবা খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনছে। এই ঘটনার স্বাক্ষী আমি নিজেই। বই পড়ার সময় তাকে টেনেও নামাতে পারিনি। কি অসম্ভব ভালো লাগার সেই চিত্র। 

সেদিন ট্রেনে আসতে আসতে টাইগারের কথা খুব মনে পড়লো। চোখের সামনে তার সেই ছবি ভেসে উঠলো। ভাবছি এমন মনোযোগি যদি স্কুলের ছেলে-মেয়েরা হয়ে ওঠে তবে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে শিক্ষকদের যে শঙ্কা সেটি নিশ্চয়ই কেটে যাবে। কিন্তু সেটি কি সম্ভব। ছাগলের বাচ্চার কাছে মোবাইল নাই। সে গেম খেলতে পারে না। তাই হয়তো বইয়ের পোকা সে। মানুষের মতো বই না পড়তে পারলেও সে বই পড়–য়াকে সঙ্গ দেয়। বাধ্য-অনুগত ছাত্রের মতো সে বসে থাকে তার ‘ম্যাডাম’র কাছে। অথচ সেই ম্যাডামই কি না তার নিজের স্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে খুবই বিচলিত। তাদের কি করে পাঠে ফিরিয়ে আনবেন তা নিয়ে শিক্ষিকা দুই বোনের চিন্তার অন্ত নেই। 

সরকারি প্রজ্ঞাপণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফের খুলেছে। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরেছে। পাঠদান শুরু হয়েছে পুরোদমে। কিন্তু পড়ার টেবিল থেকে অনেক দূরে যেসব শিক্ষার্থীর মনন চলে গেছে তা ফিরিয়ে আনতে পারে কোন প্রজ্ঞাপণ। বই মেলা শেষের পথে। কতৃপক্ষের নির্দেশে একদিন গুটিয়ে যাবে দোকানপাট। হিসেব-নিকেষ করে প্রকাশকরা তাদের লাভ-লসের খাতা বন্ধ করবেন একদিন। কিন্তু মেলায় বই কেনার বদলে অহেতুক ঘোরাফেরা আর সেলফিবাজি বন্ধ হবে কি করে? বই মেলায় গিয়ে ফাস্টফুডের দোকান খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত বাবা-মায়েদের এই অযথা মেলা দর্শণ বন্ধ হবে কবে? হয়তো এর কিছুই বন্ধ হবে না। স্কুলে ক্লাস হবে কিন্তু ক্লাসে মনোযোগি শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না। বইমেলায় হাজার হাজার মানুষ আসবে কিন্তু সত্যিকারের পাঠক আসবে না। এই বৈপরীত্য নিয়েই হয়তো আমাদের জীবনের মেলা শেষ হয়ে যাবে একদিন। এই পরস্পর বিরোধী চিত্রই হয়তো আমাদের জীবন। কেননা আমরা ‘যাহা চাই তা ভুল করে চাই। যাহা পাই তাহা চাই না’।  

লেখক: সাংবাদিক, কথাশিল্পী।   


 

রেডিওটুডে নিউজ/এমএস

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের