
দিগন্ত পেরিয়ে যখন বিশ্ব আধিপত্যের প্রতিযোগিতা মহাকাশে, তখন চীন তার নিজস্ব কক্ষপথে তৈরি করেছে এক প্রযুক্তিগত মহাকাব্য—বেইতৌ স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেম। যুক্তরাষ্ট্রের জিপিএস যেখানে সারা বিশ্বে ছড়ি ঘোরাচ্ছিল, সেখানে স্রেফ কোনো বিকল্প হিসেবে নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ, স্বাধীন ও সার্বভৌম গ্লোবাল নেভিগেশন সিস্টেম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে চীনের বেইতৌ।
বেইতৌ স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেম বা সংক্ষেপে বিডিএস হলো চীনের নিজস্ব গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম। যুক্তরাষ্ট্রের জিপিএস, রাশিয়ার গ্লোনাস বা ইউরোপের গ্যালিলিওর বিকল্প হিসেবে তৈরি করা হয়েছে এটি।
এই স্যাটেলাইট-ভিত্তিক রেডিও নেভিগেশন সিস্টেম যার মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্বে আছে চীনের জাতীয় মহাকাশ প্রশাসন। দৈনন্দিন জীবনে বুদ্ধিমান পরিবহন, লজিস্টিক, বুদ্ধিমান কৃষি এমনকি স্বয়ংক্রিয় ফসল কাটার যন্ত্রগুলোতেও কাজে লাগছে বেইতৌর লোকেশন সেবা।
বেইতৌ প্রকল্পের শুরু ১৯৯৪ সালে, যখন চীন বুঝতে পেরেছিল যে শুধু বিদেশি নেভিগেশন সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল থাকাটা জাতীয় নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ২০০০ সালে প্রথম বেইতৌ-১ সিস্টেম চালু করে চীন, যা শুধু দেশের ভেতর নেভিগেশন সেবা দিত। পরে বেইতৌ-২ সিস্টেম সেবা দিতে শুরু করে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। ২০২০ সালের ২৩ জুন, চীন বেইতৌ-৩-এর শেষ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে, যা পুরো সিস্টেমটিকে সম্পূর্ণ করে। আর তাতেই চীনের মহাকাশ প্রযুক্তিতে যোগ হয় এক নতুন মাইলফলক।
বেইতৌ সিস্টেমের অধীনে ২০০০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কক্ষপথে পাঠানো হয় মোট ৬৪টি স্যাটেলাইট। আর এখন পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের কক্ষপথে বেইতৌর অধীনে কার্যকর স্যাটেলাইট আছে ৫০টিরও বেশি। যেখানে মার্কিন গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম বা জিপিএস-এর জন্য রয়েছে ৩১টি স্যাটেলাইট।
বেইতৌর মূল সক্ষমতাটি হলো এর উচ্চ নির্ভুলতা। বেইতৌ-৩ সিস্টেম সামগ্রিকভাবে মিটার-পর্যায়ের নির্ভুল হিসাব দেয়, যা বেসামরিক ও সামরিক দুটো কাজেই ব্যবহার করা যায়।
জিপিএস-এর চেয়ে বেইতৌর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো বেইতৌ তার ব্যবহারকারীদের জরুরি ক্ষুধে বার্তা পাঠানোর সুবিধাও দেয়, যা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবার অনেক বিশেষজ্ঞই জানিয়েছেন, সিগনালের শক্তি, নিখুঁত অবস্থান নির্ণয় ও নির্ভরযোগ্যতার বিচারে জিপিএস-এর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে বেইতৌ।
চীনের স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন ও অবস্থান-নির্ভর সেবাখাতে ২০২৫ সালের একটি শ্বেতপত্র প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে চীনে স্যাটেলাইট-নির্ভর ন্যাভিগেশন ও অবস্থান ফিচারযুক্ত প্রায় ৪১ কোটি টার্মিনাল ডিভাইস বিক্রি হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ৩০ কোটি স্মার্টফোন এবং ২ কোটির বেশি গাড়িতে ব্যবহৃত পজিশনিং ডিভাইস।
আর ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ মূল ভূখণ্ড চীনে ২০০ কোটির বেশি স্মার্টফোন, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ডিভাইস বেইতৌ স্যাটেলাইট সিস্টেমের সেবা গ্রহণে সক্ষম হয়েছে।
বর্তমানে চীনের অভ্যন্তরে প্রায় ২০ হাজার প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় প্রায় ১০ লাখ লোক বেইতৌ ও অন্যান্য স্যাটেলাইট-নির্ভর অবস্থান নির্ণয় ও ন্যাভিগেশন সেবার সঙ্গে যুক্ত।
এ পর্যন্ত বিশ্বের ১২০টিরও বেশি দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে বেইতৌ। বিশেষ করে "বেল্ট অ্যান্ড রোড" উদ্যোগের অংশীদার দেশগুলোতে। পাকিস্তান, মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় বেইতৌ ব্যবহার করছে।
জাতিসংঘ স্বীকৃত বৈশ্বিক স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেমের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী হিসেবে বেইতৌ ইতোমধ্যেই বেসামরিক বিমান চলাচল, সমুদ্র পরিবহন ও মোবাইল যোগাযোগের মতো খাতে ১১টি আন্তর্জাতিক মানসংস্থার স্ট্যান্ডার্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নাইজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও সেনেগালসহ ৩০টিরও বেশি আফ্রিকান দেশে বেইতৌ রেফারেন্স স্টেশন চালু হয়েছে।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম