
বৈরী আবহাওয়ায় দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে উত্তাল রয়েছে কক্সবাজার সাগরতীর। অতিরিক্ত জোয়ারে দিনদিন লোকালয়ে ঢুকছে পানি। ঢেউয়ের তীব্রতায় বেলাভূমির তীর ভেঙে শত কিলোমিটার সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে উপড়ে গেছে কয়েক হাজার ঝাউগাছ। তীব্র ঢেউ সৈকতে থাকা পুলিশ বক্স, ওয়াচ টাওয়ার এবং অস্থায়ী দোকানপাটও তলিয়ে নিয়ে গেছে।
সাম্প্রতিক নিম্নচাপ ও অমানিশা প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে এসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও বেশকিছু স্থাপনা। নিত্যদিনের ভাঙনে আতঙ্ক তাড়া করছে সৈকত কেন্দ্রিক পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রকৃতির এ রুদ্ররোষে ভুগছে উপকূল।
সৈকতে পর্যটক নিরাপত্তায় থাকা সি সেইফ লাইফ গার্ডের সিনিয়র কর্মী ও ট্রেইনার মুহাম্মদ ওসমান বলেন, বিশাল ঢেউয়ের তোড়ে সৈকতের জিওব্যাগও টিকছে না। জিওব্যাগ ডিঙিয়ে ঢেউ আঘাত হানছে ঝাউবনে। গত এক দশকে সাগর প্রায় তিন কিলোমিটার লোকালয়ে ঢুকে গেছে। এটা অব্যাহত রয়েছে। ঢেউয়ের তীব্রতায় পর্যটকদের সাগরে নামতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পর্যটকরাও পানিতে না নেমে দূর থেকে সাগরের উত্তাল রূপ উপভোগ করছেন, ছবি তুলছেন এবং কেউ কেউ ভিডিও ধারণ করছেন। তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পর্যটন অনুষঙ্গ কিটকট ও জেটস্কি বালুচর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। লাবণী-সুগন্ধা এবং শৈবাল পয়েন্টে শত শত কিটকট উঠিয়ে রাখা হয়েছে। জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা ৪ থেকে ৫ ফুট পর্যন্ত উঠে সাগর উত্তাল। ট্যুরিস্ট পুলিশ, লাইফ গার্ড ও বিচ কর্মীরা একযোগে মাইকিংয়ে সতর্ক করে।
সরেজমিন সৈকতের শৈবাল, লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলী, কবিতা চত্বর, সমিতি পাড়াসহ কয়েকটি পয়েন্টে গিয়ে দেখা মিলে ভাঙনের তীব্রতা। ঢেউয়ের আঘাতে সৈকতের বিভিন্ন এলাকায় বেলাভূমি ভাঙনের কবলে পড়েছে। ভেঙে সাগর গর্ভে তলিয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। এছাড়াও ভাঙনের উপক্রম হয়েছে একটি রেস্তোরাঁ। শৈবাল পয়েন্টে দুটি বৈদ্যুতিক খুঁটির উপর ঝাউগাছ ভেঙে পড়ায় আশপাশের এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়। পরে সেই গাছ কেটে সরিয়ে নেওয়া হলেও ঝুঁকিতে রয়েছে আরও কিছু খুঁটি। এরকম ভাঙন অব্যাহত থাকলে সৈকত ঘেঁষে গড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যালয়, জেলা প্রশাসনের তথ্য ও অভিযোগ কেন্দ্রসহ আরও কিছু স্থাপনা অচিরে সাগর গর্ভে হারানোর আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
কক্সবাজার বনবিভাগ সূত্র জানায়, সদর রেঞ্জের নাজিরারটেক থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত ১৯৬১-৬২ সালে ১২ হেক্টর বালিয়াড়িতে সৃজন হয় ঝাউবন। ১৯৭৪ সালে ঝাউ বাগানের প্রসার ঘটানো হয়। তখন থেকে এ ঝাউবাগান সমুদ্রপাড়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি অনুসর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পাশাপাশি দুর্যোগ প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবেও পরিগণিত হয়। তবে ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে অর্ধেকের বেশি বাগান বিলীন হয়।
সূত্র আরও জানায়, ১৯৯১-৯২ সালে ১২ হেক্টর বেলাভূমিতে নতুন করে প্রায় ৩০ হাজার চারা রোপণ করা হয়। ১৯৯৬-৯৭ সালে ১১৫ হেক্টরে রোপণ হয় তিন লক্ষাধিক ঝাউ গাছের চারা। ১৯৯৭-৯৮ সালে ৪০ হেক্টরে লক্ষাধিক, ১৯৯৮-৯৯ সালে ৫ হেক্টরে সাড়ে ১২ হাজার, ২০০২-০৩ সালে ৮ হেক্টরে ২০ হাজার, ২০০৩-০৪ সালে ৮৭ হেক্টরে ২ লাখ ১৭ হাজার ও ২০১০-১১ সালে ৫ হেক্টরে সাড়ে ১২ হাজার চারা রোপণ করা হয়। প্রতি হেক্টরে আড়াই হাজার করে প্রায় ৩০০ হেক্টরে সাড়ে সাত লক্ষাধিক ঝাউগাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জোয়ারের ঢেউয়ের ধাক্কায় ভাঙতে থাকে সৈকতের বেলাভূমি। সমুদ্র তলদেশে উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে জোয়ারের ঢেউয়ের তোড়ও বেড়ে যায়। বড় ঢেউয়ের তোড় ঝাউগাছের গোঁড়ায় পড়ে সরে যাচ্ছে গোঁড়ার বালি। এতে পরবর্তী ঢেউয়ে উপড়ে পড়ে বিলীন হচ্ছে নয়নাভিরাম ঝাউবন।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. হাবিবুল হক বলেন, ঢেউয়ে তোড়ে ঝাউগাছের গোঁড়া থেকে মাটি সরে গাছ উপড়ে পড়ছে। ১৯৭২-৭৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে ঝাউগাছ লাগানো হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড বা অন্য প্রকল্পের মাধ্যমে সৈকত তীরে আধুনিক পদ্ধতিতে কোনো বাঁধ নির্মাণ করা গেলে ঝাউবন রক্ষার পাশাপাশি উপকূলও রক্ষা পেত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কক্সবাজার কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর জিও ব্যাগ বসিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। তবে তাতে স্থায়ী সমাধান হয় না। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও উপযুক্ত বাঁধ ছাড়া সৈকত তীর রক্ষা অসম্ভব।
আবহাওয়া অধিদপ্তর কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ আব্দুল হান্নান বলেন, আবহাওয়ার সর্বশেষ বুলেটিন মতে সক্রিয় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে সোমবার এবং পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা রয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহিদুল আলম বলেন, বর্ষায় ক্ষণে ক্ষণে সাগরের পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। লঘু বা নিম্নচাপ তৈরি হলে বৈরী আবহাওয়ায় সাগর উত্তাল হয়ে উঠে। অনেক সময় জোয়ারের চেয়ে কয়েক ফুট উঁচু হয়ে উপচে পড়ে ঢেউ। সাম্প্রতিক নিম্নচাপ ও অমানিশার জোয়ারের প্রভাবে সাগরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, কুতুবদিয়ার সাগর তীরবর্তী এলাকা ভাঙনের কবলে পড়ে। একইভাবে ঢেউয়ের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সৈকতের তীর ও বেলাভূমি। উপড়ে পড়েছে হাজারো ঝাউগাছ। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় না। তবে, ক্ষতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সেই বিষয়ে ভাবছে জেলা প্রশাসন।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম