
রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত খসড়ার হাইব্রিড স্কুলিং পদ্ধতি প্রত্যাখান করে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সকালে কলেজের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজের স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষা করে আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবাদ জানান তারা।
শিক্ষার্থীরা বলেন, বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও বিকেন্দ্রীভূত করার লক্ষ্যে ঢাকার সরকারি সাতটি কলেজকে একত্রিত করে কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে এবং শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি অভিন্ন কাঠামোর অধীনে পরিচালনার জন্য দীর্ঘ এক বছর আন্দোলন করে আসছি। এরই ফলস্বরূপ শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে প্রস্তাবিত ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খসরা প্রকাশ করেন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, শিক্ষা মন্ত্রনালয় ক্যাম্পাসগুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের মতামতের উপর গুরুত্ব না দিয়ে অযৌক্তিক এবং অনুপযোগী একটি খসড়া প্রকাশ করেছে, যা ক্যাম্পাসগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সদ্য প্রকাশিত স্কুলিং (হাইব্রিড) পদ্ধতির খসরার বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কল্যানে ঢাকা কলেজের বিভিন্ন গ্রুপগুলো থেকে জানতে পেরেছি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরাও এর ব্যাতিক্রম নয়।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, ‘আন্দোলনের শুরু থেকে আমাদের লক্ষ্য ছিল রাজধানীর সরকারি সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি থেকে বের হয়ে একটি অভিন্ন কাঠামোর অধীনে স্ব স্ব ক্যাম্পাসগুলোর স্বাতন্ত্র্যতা বজায় রেখে একটি বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হবে। সদ্য প্রকাশিত হওয়া খসরায় আমরা লক্ষ করেছি যে, স্কুলিং (হাইব্রিড) সিস্টেমের মাধ্যমে ক্যাম্পাসগুলোর স্বাতন্ত্র্য ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা জন্ম দিয়েছে।’
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘প্রকাশিত হওয়া খসরার তিন এর তৃতীয় ধাপে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনা অংশে বলা হয়েছে৷ এই আইনের বিধান সাপেক্ষে ক্যাম্পাসগুলোর স্থাবর-অস্থাবর সকল প্রকার সম্পত্তি অর্জন করিবার অধিকার রাখিবে এবং হস্তান্তর করার ক্ষমতা রাখিবে। এই ধারা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, ভবিষ্যতে কলেজগুলোর এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে শিষ্কার্থীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পরবর্তী ধাপে বলা হয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয় এর সাতটি একাডেমিক ক্যাম্পাস থাকিবে- অর্থাৎ সাতটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি ক্যাম্পাস হিসেবে পরিচিত হইবে। যেমন- ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি তিতুমীর কলেজ ক্যাম্পাস। ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি ইডেন মহিলা কলেজ ক্যাম্পাস। এই ধারা অনুযায়ী স্পষ্ট ভাবে বুঝা যাচ্ছে, ইডেন ও বদরুন্নেসা ক্যাম্পাস গুলোতে সহ শিক্ষা চালু করা হবে। যার মাধ্যমে শত বছর ধরে নারীদের জন্য ডেডিকেটেড মহিলা কলেজ গুলো তে নারীদের অগ্রাধিকার হ্রাস পাবে।’
তারা বলেন, ‘খসরার তিন এর ৭নং ধাপে বলা হয়েছে- শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত ঢাকা মহানগরের সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ক্যাম্পাসের পরীক্ষাগারসহ অন্যান্য সমজাতীয় সুযোগসুবিধা প্রযোজনে শর্তসাপেক্ষে ব্যবহার করিতে পারিবেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্পষ্ট ভাবে লক্ষনীয় যে, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা কালীন সময় ঢাকা কলেজ কার্জন হল, শহীদুল্লাহ হল, শিক্ষার্থী, বই খাতা কলম সহ সকল কিছুই বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়েছে। লক্ষনীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দেওয়া ঢাকা কলেজের সেই ক্যাম্পাসে, সেই হলে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরাই বহিরাগত হিসেবে পরিগনিত। এখন ২০২৫ সালে এসে আবার ১৯২১ সালের পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে যা খুবই দুঃখজনক ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। সেইসঙ্গে খসরার ২ এর শ অনুযায়ী কলেজগুলোর প্রায় দুই শত বছরের এলামনাইদের পরিচয় সম্পূর্ণভাবে ভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে। একই সাথে প্রস্তাবিত মডেল বাস্তবায়ন হলে ক্যাম্পাসে অধ্যায়নরত বর্তমান এবং সাবেকরা বহিরাগত হিসেবে পরিগনিত হবে।’
তারা বলেন, ‘খসরার ৫এর এ নং ধাপে বলা হয়েছে- কমিশনের পূর্বানুমোদনক্রমে শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা উন্নয়নের লক্ষ্যে একাডেমি, মিউজিয়াম, স্কুল, ডিসিপ্লিন, বিজনেস ইনকিউবেটর প্রতিষ্ঠা বা ক্ষেত্রমত রক্ষণাবেক্ষণ সম্প্রসারণ একত্রিকরণ ও বিলোপ সাধন করা। এখানে লক্ষনীয় যে, নির্দিষ্ট কোন ফ্যাসিলিটির যেটা কলেজ চাচ্ছে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছে না, অথবা বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছে কলেজ চাচ্ছেনা এই যে একটা সাংঘর্ষিক সম্পর্ক, এটার সমাধান কি হবে?। বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই ধর্ম ভিত্তিক সাবজেক্টগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সদ্য প্রকাশিত খসরার দেখতে পায়, বর্তমানে সাত কলেজে যে সাবজেক্টগুলো রয়েছে তা অধিকাংশই এখানে নেই। বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইসলামিক স্টাডিজ এবং ধর্মীয় রিলেটেড সাবজেক্টগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। ধর্ম ভিত্তিক সাবজেক্টগুলো বাদ দিয়ে ধর্ম বিদ্বেষী মনোভাব দেখতে পাচ্ছি।’
শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘বর্তমানে ৫ টি কলেজের ইন্টারমিডিয়েট স্তর কার অধীনে পরিচালিত হবে সে বিষয়ে খসড়ায় কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। বিশেষত ঢাকা কলেজের ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার গুরুত্ব ও লিগ্যাসি কীভাবে সংরক্ষিত হবে, সে সম্পর্কেও কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়নি। ফ্যাকাল্টি বেইজড মাল্টিক্যাম্পাস ইউনিভার্সিটির উদাহরণ বাংলাদেশের কোথাও নাই। কোন রকমের অভিজ্ঞতা ছাড়া পূর্বে যেমন সাত কলেজকে ঢাবি অধিভুক্ত করে যে ভুল করা হয়েছিল সেই ভুল আবার করতে দেওয়া হবে না।’
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা আন্দোলনের প্রথম থেকেই অক্সফোর্ড মডেল প্রস্তাব করেছিলাম, যেখানে---(কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়) ডিগ্রি প্রদান, পাঠ্যক্রম নির্ধারণ, পরীক্ষা আযোজন, গবেষণার দিকনির্দেশনা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে অপর দিকে কলেজসমূহ স্বায়ত্তশাসিত, যারা প্রশাসনিক ও আর্থিকভাবে স্বাধীন হয়ে থাকে। এই মডেলে কলেজ সমূহে নিজস্বও গভর্নিং বডি ও সম্পদ থাকে। সাত কলেজের স্বাতন্ত্র্যতা রক্ষা এবং শিষ্কার উন্নতিকল্পে অবশ্যই এবং অবশ্যই অক্সফোর্ড মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে।’
শিক্ষার্থীরা বলেন, এই খসড়া প্রত্যাহার করে সমযোপযোগী ও সাসটেইনেবল আইনপ্রণয়ন লক্ষ্যে প্রযোজন স্বাপেক্ষে কমিশন গঠন করতে হবে। একই সাথে ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়নে সাত কলেজের প্রতিটা স্টেক হোল্ডারের মতামত ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা বলেন, ইন্টারমিডিয়েটের শিক্ষার্থীদের মতামত নিতে হবে। সাতটি কলেজের সকল সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের মতামত নিতে হবে। সকল সাধারণ শিক্ষক ও এলামনাই সদস্যদের সাথে আলোচনা করতে হবে। ৭ দিনের সময় বেঁধে দিয়ে প্রহসনমূলক ইমেইলের মাধ্যমে মতামত গ্রহণ বাদ দিয়ে সরাসরি আলোচনায় বসতে হবে। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত কর্মচারীদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।
তারা বলেন, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও সকল স্টেকহোল্ডারের প্রতিনিধিত্ববিহীন কোনো উদ্যোগ সাফল্য লাভ করতে পারবে না। রাষ্ট্র ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রতি আহ্বান আলোচনার মাধ্যমে দাবি মেনে নেন।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম