
বাংলাদেশ ও নেপালের পর এবার জেন-জিদের বিক্ষোভ দেখলো ভারত। দেশটির কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল লাদাখে গতকাল বুধবার বিক্ষোভ করেন ছাত্র-জনতা। স্থানীয় রাজনীতিবিদরাই বলছেন, এই বিক্ষোভের অনুপ্রেরণা নেওয়া হয়েছে ঢাকা ও কাঠমান্ডুর আন্দোলন থেকে।
নেপাল ও বাংলাদেশের মতো লাদাখের বিক্ষোভেও একটি বিষয় সাধারণ। সেটি হলো বেকারত্ব ও চাকরির দাবি। মূলত, চাকরির সংকট নিরসনের জন্যই লাদাখকে আলাদা রাজ্য করার দাবি তুলেছেন বিক্ষোভকারীরা।
এই বিক্ষোভের পেছনে ইন্ধনদাতা হিসেবে সোনম ওয়াংচুকের নাম উল্লেখ করেছেন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা ও সরকারি কর্মকর্তারা। সেই ওয়াংচুকও ভিডিও বার্তায় বলেছেন, বেকারত্ব ও আঞ্চলিক সুরক্ষা না থাকাটাই মানুষের ক্ষোভের ‘রেসিপি’ হয়েছে।
বুধবারের বিক্ষোভের কারণ ও এর পরবর্তী প্রভাব নিয়ে আলোচনার আগে সোনম ওয়াংচুকের পরিচয় জানা যাক।
কে এই ওয়াংচুক
সোনম ওয়াংচুক লাদাখের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী। একই সঙ্গে তিনি লেহ অ্যাপেক্স বডির সদস্য। এই সংগঠনটিই লাদাখকে পৃথক রাজ্য করার দাবিতে আন্দোলন করছে।
পেশায় প্রকৌশলী ওয়াংচুক ১৯৮৮ সালে লাদাখে গড়ে তোলেন স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ (এসইসিএমওএল)। যেটির মাধ্যমে তিনি লাদাখের বিদ্যালয়ে পাঠদান ব্যবস্থার সংস্কার শুরু করেন। জোর দেন প্রায়োগিক শিক্ষার ওপর।
ওয়াংচুক বেশি পরিচিতি পান আমির খান অভিনীত ‘থ্রি-ইডিয়টস’ সিনেমা মুক্তির পর। লাদাখে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকারী ওয়াংচুকের জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমায় র্যাঞ্চো বা র্যাঞ্চোরদাস শ্যামলদাস চ্যাঞ্চোড় ও ফংসুখ ওয়াংড়ুর চরিত্র তৈরি করা হয়েছে। যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন আমির খান নিজে।
আল জাজিরা বলছে, চলতি মাসের শুরুতে নেপালে জেন-জি বিক্ষোভে প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি পদত্যাগ করলে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছিলেন সোনম ওয়াংচুক। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি (নেপালে) ছিল তরুণদের বিক্ষোভ। এক ধরনের জেন-জি বিপ্লব, যা তাদের রাস্তায় নামিয়েছে।’
গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে লাদাখের স্বায়ত্তশাসন দাবিতে অ্যাপেক্স বডির অন্য সদস্যদের সঙ্গে অনশনে বসেছিলেন ৫৯ বছর বয়সী ওয়াংচুকও।
বিক্ষোভকারীরা কি জেন-জি
বিক্ষোভকারীরা জেন-জি কি না তা নিয়ে ভারতে দুই ধরনের বয়ান তৈরি হয়েছে। ভারতের সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের একাংশ বলছে, এই বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে জেন-জিদের নেতৃত্বে। যাদের ‘উসকানি’ দিয়েছেন সোনম ওয়াংচুক। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সোনম। বলেছেন, তিনি উল্টো তরুণদের সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
নেপালের জেন-জি বিপ্লবের কয়েক দিনের মাথায় লাদাখে সংঘাত হওয়ায় ওয়াংচুকের ইন্ধন আছে বলে দাবি করেছে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। তাদের অভিযোগ, ওয়াংচুক আরব বসন্ত ও নেপালের আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তরুণদের বিক্ষোভের উসকানি দিয়েছেন।
আর লাদাখের লেফটেন্যান্ট গভর্নর কাবিন্দর গুপ্তা বলেছেন, যারা এই আন্দোলনকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ও নেপালের জেন-জি আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করছেন, তারাই সহিংসতার জন্য দায়ী। একটি ভিডিও বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আজ (বুধবার) যদি এটি থামানো না যেত, তাহলে তারা পুরো লেহ ধ্বংস করার চেষ্টা করতো।’
অপরদিকে বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র ও লোকসভার সদস্য সম্বিত পাতরার অভিযোগ, লাদাখের ঘটনার পেছনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও মার্কিন প্রভাবশালী বিনিয়োগকারী জর্জ সোরসের ষড়যন্ত্র আছে। সম্বিতের অভিযোগ, ভারতেও বাংলাদেশ, নেপাল ও ফিলিপাইনসের মতো ঘটনা ঘটনানোর জন্য রাহুল গান্ধী বারবার উসকানি দিয়েছেন।
তবে কাশ্মীরে অবস্থানরত জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের সাংবাদিক স্যমন্তক ঘোষ বলছেন, এটাকে জেন-জি’র আন্দোলন বলা যেতে পারে। অনশনরত দুজনের শরীর খারাপ হওয়ার পর তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হলে জেন-জি’র একাংশ ক্ষুব্ধ হন। তারাই মূলত রাস্তায় নামেন।
কেন আলাদা রাজ্যের দাবি
লাদাখ ২০১৯ সালের আগস্টের আগে ছিল ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে অংশ। কিন্তু ওই বছর জম্মু-কাশ্মীর থেকে লাদাখকে আলাদা করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়। তবে রাজ্য থেকে আলাদা হওয়ার পর দেখা দেয় চাকরির সংকট।
আল জাজিরার তথ্য, রাজ্যের মর্যাদা শেষ হওয়ার পর থেকেই লাদাখবাসীদের জন্য জম্মু ও কাশ্মীরে সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। ২০১৯ সাল থেকেই স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন যে, সরকার তাদের চাকরির নিয়োগে স্পষ্ট নীতি প্রণয়ন করেনি।
লাদাখের সাক্ষরতার হার ৯৭ শতাংশ, যা ভারতের জাতীয় গড়ের (প্রায় ৮০ শতাংশ) চেয়ে অনেক বেশি। ২০২৩ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, লাদাখের স্নাতকদের ২৬ দশমিক ৫ শতাংশই বেকার। একটি অঞ্চলের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় শতভাগ শিক্ষিত হওয়ার পরও বেকার থাকায় তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধেছে।
লাদাখের কার্গিল জেলার স্টুডেন্টস এডুকেশন মুভমেন্টের সভাপতি আহমেদ কাদরি ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টকে বলেছেন, এখানে যুবকদের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর শিক্ষার্থীরা আশা করে সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হবে। তারা পরীক্ষা দিয়ে চাকরি নেবে। কিন্তু প্রতিবারই তারা হতাশ হয়। গত পাঁচ বছরে সরকার নিয়োগের কোনো নিয়মই করতে পারেনি।
গতকাল বুধবার সোনম ওয়াংচুকও বলেছেন, ‘তরুণরা গত পাঁচ বছর ধরে বেকার। এ ছাড়া অঞ্চলের সাংবিধানিক সুরক্ষাও দেওয়া হচ্ছে না। এটাই সামাজিক অস্থিরতার রেসিপি।’
২০১৯ সালের পর থেকেই লাদাখকে আলাদা রাজ্য করার দাবি উঠলেও নরেন্দ্র মোদি প্রশাসন তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিক্ষোভে সহিংসতার শুরু যেভাবে
অ্যাপেক্স বডির যে ১৫ সদস্য ১০ সেপ্টেম্বর থেকে অনশনে বসেছিলেন তাদের মধ্যে দুজন গত মঙ্গলবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার লাদাখে হরতালের ডাক দেয় লেহ অ্যাপেক্স বডির যুব শাখা।
হিন্দুস্থান টাইমস ও এএফপির তথ্য- বুধবার বিপুল সংখক মানুষ লাদাখের প্রধান শহর লেহ’তে জড়ো হয়ে মিছিল শুরু করেন। এর এক পর্যায়ে কিছু যুবক লাদাখে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ও হিল কাউন্সিলের দপ্তরে পাথর ছোঁড়েন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ারশেল ও লাঠিপেটা করে। তখন পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত পাঁচজন নিহত হন। আহত হন পুলিশ সদস্যসহ বেশ কয়েকজন। পরে অঞ্চলটিতে জনসমাগমে বিধিনিষেধ জারি হয়।
লেহ অ্যাপেক্স বডির সহ-সভাপতি চেরিং দর্জের বরাত দিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, সহিংসতায় আহত হন অন্তত ৭০ জন।
লাদাখে সংঘাতের প্রভাব
ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই লাদাখ ভারতের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলেছি, এর একপাশে পাকিস্তান, আরেক পাশে চীন।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ লাদাখের কার্গিল জেলা নিয়ে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সংঘাত হয়। যা কার্গিল যুদ্ধ নামে পরিচিত। অপরদিকে লাদাখের একটি অংশ চীনের মধ্যেও পড়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে একটি এলএসি (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) আছে। এরপরও ২০২০ সালে ভারত ও চীনের সেনারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে সংঘাতে জড়ায়। এতে ২০ ভারতীয় ও চীনের চার সেনা নিহত হন।
অর্থ্যাৎ, লাদাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পাকিস্তান ও চীন উভয় প্রতিবেশীর সঙ্গেই ভারতের দ্বন্দ্ব আছে। বলা হয়ে থাকে, এ কারণেই অঞ্চলটিকে জম্মু-কাশ্মীর থেকে আলাদা করে কেন্দ্রের শাসনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন সেখানে বিক্ষোভ ও সহিংসতার মতো ঘটলে কিংবা স্বায়ত্তশাসনের দাবি দীর্ঘায়িত হলে স্বাভাবিকভাবেই অভ্যন্তরীণ ও ভূরাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে পড়বে নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন।
রেডিওটুডে নিউজ/আনাম