নারীদের কর্মঘণ্টা নিয়ে আলোচনার পেছনে রাজনীতি কী?

রোববার,

১৬ নভেম্বর ২০২৫,

২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

রোববার,

১৬ নভেম্বর ২০২৫,

২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

Radio Today News

নারীদের কর্মঘণ্টা নিয়ে আলোচনার পেছনে রাজনীতি কী?

রেডিওটুডে রিপোর্ট

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

Google News
নারীদের কর্মঘণ্টা নিয়ে আলোচনার পেছনে রাজনীতি কী?

কর্মজীবী নারীদের কর্মঘণ্টা কমানোর প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা চলার পর বিএনপির দিক থেকে পাল্টা রাজনৈতিক আক্রমণও দেখা গেছে।

রাজনৈতিক রেষারেষির বাইরে আসলেই নারীদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনার কথার পেছনে উদ্দেশ্য কী বা এর যৌক্তিকতা কতটুকু সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।

কর্মঘণ্টা কমিয়ে নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব কি না, দেশের বিশাল এই শ্রমশক্তির কর্মঘণ্টা কমানো কিংবা ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে কতটা যৌক্তিক–– এমন নানা বিষয় ঘুরেফিরেই আসছে সাধারণ মানুষের আলোচনার।

'চটকদার' বক্তব্য দিয়ে নারীদের হাতিয়ার করে ভোটের রাজনীতিতে এগিয়ে থাকার চেষ্টা চলছে কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে।

তবে এ ধরনের অবস্থান আদতে নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ তৈরি করবে বলেই মনে করেন নারী অধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, নারীদের কর্মঘণ্টা না কমিয়ে বরং কর্মক্ষেত্রে বেতন, পদোন্নতিসহ নানা বিষয়ে তাদের প্রতি যে বৈষম্য রয়েছে, সেটি কীভাবে দূর করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন।

এই আলোচনা কেবল রাজনৈতিক প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয় বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের শঙ্কা, বাস্তবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ আরও সংকুচিত হবে।

এছাড়া, নারীদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে ভর্তুকি দিতে হলে, সরকারকে যে পরিমাণ অর্থ এই খাতে বরাদ্দ করতে হবে সেই সক্ষমতা বা যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস এর তথ্য অনুসারে, দেশে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৪ দশমিক দুই শতাংশই নারী। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক খাত মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় আড়াই কোটি নারী বর্তমানে কর্মে নিয়োজিত।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, "আমি হিসাব করে দেখেছি নারীদের পাঁচ কর্মঘণ্টার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুধু গার্মেন্টস সেক্টরেই অন্তত ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে"।

কেন আলোচনায় নারীদের কর্মঘণ্টা

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি একটি কর্মসূচিতে বলেছেন, তার দল ক্ষমতায় গেলে কর্মজীবী নারীদের কর্মসময় আট ঘণ্টা থেকে কমিয়ে পাঁচ ঘণ্টা করবে। এছাড়া যেসব নারী ঘরে সময় দেবেন তাদেরকেও স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

ক্ষমতায় গেলে নারীদের জন্য কর্মে নিয়োগের আলাদা নীতিমালা করার কথাও বলেছেন তিনি।

তার মতে, "নারীদের কর্মঘণ্টা কমানোর বিষয়টি অবাস্তব নয়, বরং এটি বাস্তবায়নযোগ্য উদ্যোগ। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এতে ক্ষতির মুখে পড়ে, তাহলে সরকার তাদের জন্য তিন ঘণ্টার সমপরিমাণ ভর্তুকি দেবে"।

এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক অনুষ্ঠানে নারীদের কর্মঘণ্টা ইস্যুতে কথা বলেছিলেন মি. রহমান।

সম্প্রতি তার এই বক্তব্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও করেছেন অনেকে। বিশেষ করে নারী স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষায় জামায়াত আমিরের এই পরিকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত এ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

বিএনপি এই বক্তব্যের সূত্র ধরে পাল্টা আক্রমণও করেছে।

শুক্রবার ঢাকায় এক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, "তারা (জামায়াত) চায় যেন এ দেশের নারীরা অন্দরমহলে বন্দি থাকে। যেন বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী অন্ধকারে থাকে এবং নারীদের প্রগতি, অগ্রগতি না হয়। সেজন্য তারা বলছে, কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিতে হবে কর্মসংস্থানের যাতে কোনোরকমের অসুবিধা না হয়। অথচ দেখা যায়, কর্মঘণ্টা কমিয়ে দিলেই নারীদের কর্মসংস্থান কমে যাবে"।

"যারা এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য খারাপ। তারা চায় নারীরা অন্দরমহলে বন্দি থাকুক। সমাজের অগ্রগতি তারা চায় না," বলেন তিনি।

শাহবাগ আয়োজিত ওই কর্মসূচিতে—"পাঁচ নয় আট, তুমি বলবার কে?"এ রকম স্লোগান দিতে দেখা যেগে সেখান অংশ নেওয়া নারীদের।

আবার শুক্রবার একই দিনে রাজশাহীতে একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের একটি বক্তব্যও গণমাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিয়ে ছাপিয়েছে যেখানে তিনি বলেছেন, "দেশের ৫০ ভাগ নারী, তাদের বাদ দিয়ে উন্নয়ন-চিন্তা করলে তা ভুল হবে"।

এত আলোচনার মাঝে বাংলাদেশে নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার কর্মীরা অবশ্য জামায়াত নেতার বক্তব্যকে 'অযৌক্তিক' এবং নারীদের ওপর 'নিয়ন্ত্রণ আরোপের কৌশল' হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে মাঝেমধ্যে এমন বক্তব্য দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা।

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, "এই বক্তব্য নারীদের সম্মান করে দেওয়া হচ্ছে না, বরং নারীদেরকে ঘরে ঢোকানোর জন্য বলা হয়েছে, তারা মহিলাদেরকে কন্ট্রোল করতে চায়"।

এমন বক্তব্যের মাধ্যমে নারীদেরকে 'অপমান' করা হচ্ছে বলেও মনে করেন নারী অধিকারকর্মী খুশি কবির। তিনি বলছেন, "নারীদেরকে নিয়ন্ত্রণের চিন্তা থেকেই এমন বক্তব্য দিচ্ছে জামায়াত। সেটা না হলে নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি বা বৈষম্য দূর করার বিষয়ে তারা কথা বলতো"।

মিজ কবির বিবিসি বাংলাকে বলছেন, "কর্মক্ষেত্রে কেবল অর্থ আয়টাই মূল বিষয় নয়। একজন নারী নিজস্ব ডিসিশন মেকার, তার ওপর কেনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হবে কেন? এছাড়া দেশের কর্মক্ষম অর্ধেক জনসংখ্যা কাজ না করে বসে থাকবে এটাও তো অযৌক্তিক"।

এই সিদ্ধান্ত কি বাস্তবায়নযোগ্য?

সরকার গঠন করতে পারলে নারীদের কর্মঘণ্টা কমানো এবং ভর্তুকি দেওয়ার প্রসঙ্গে জামায়াতের আমিরের বক্তব্য কতটা বাস্তবায়নযোগ্য, সে প্রশ্নও উঠেছে। দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি সম্ভব কি না তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, দেশের মোট জনশক্তির অর্ধেকই নারী, যার প্রায় আড়াই কোটি এই মুহূর্তে কর্মক্ষেত্রে জড়িত। এই বিশাল সংখ্যক কর্মীর কর্মঘণ্টা কমিয়ে ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্তও যৌক্তিক নয়।

পোশাক শিল্পের উদাহরণ টেনে মি. রহমান বলেন, পাঁচ ঘণ্টা কাজের পর নারীদের ক্ষেত্রে বাকি তিন কর্মঘণ্টার বেতন যদি ভর্তুকি আকারেও সরকার দিতে চায় তাহলে কেবল পোশাক শিল্পেই প্রায় ২১ লাখ কর্মীর জন্য অন্তত ১৬ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।

"আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা আছে কি না, শ্রমশক্তি হিসেবে একজন কর্মীকে ব্যবহার করা গেল কি না এই বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ," বলেন তিনি।

এর মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারীরা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও নারী অধিকারকর্মীরা।

কর্মক্ষেত্রে নারীরা পাঁচ ঘণ্টা কাজ করবে, এমটা হলে নিয়োগদাতারা তাদের চাকরি দিতে খুব একটা আগ্রহী হবেন না, সবমিলিয়ে "আমার তো মনে হয় না যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এটি খুব ভালো ডিসিশন হবে," বলেন মি. রহমান।

কী যুক্তি দিচ্ছে জামায়াত?

এদিকে, রাজনৈতিক আক্রমণ ও নারী অধিকারকর্মীদের সমালোচনায় পাল্টা প্রশ্ন করছেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "যারা নারী অধিকারের কথা বলছে তারা নারীদের জন্য কী অধিকার অর্জন করতে পেরেছে?"

তিনি যুক্তি দেন, "পাঁচ ঘণ্টা কাজ করার মাধ্যমে অন্য বেকার যারা আছেন তাদেরও কর্মসংস্থান হবে"।

রাজনৈতিক দলে কেউ সমালোচনা করলে সেটা তাদের 'এজেন্ডা', কিন্তু জামায়াতে ইসলামী বরং এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নারীদের জন্য "আরও কর্মসংস্থান তৈরি করছে" বলেও তিনি যুক্তি দেন।

"তিন ঘণ্টা কর্মঘণ্টার ভর্তুকি সরকার দেবে–– এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যে অর্থনীতিবিদরা সমালোচনা করছেন, দেশ থেকে যখন হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে তখন তারা কোথায় ছিলেন?" পাল্টা প্রশ্ন এই জামায়াত নেতার।

সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন কতদূর

গত কয়েকদিনে নারী অধিকার নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচনা হলেও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। উল্টো কিছু দিন আগে এই কমিশন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনও করেছে কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল।

কমিশনের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলছেন, নারী ভোট ব্যাংক নিজেদের পক্ষে টানতে চাইলেও নারীদের স্বাধীনতা দেওয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই তেমন আগ্রহী নন।

"নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কাজের সময় তারা (ধর্মভিত্তিক দলগুলো) যে আচরণ করেছিল সেটা তো ভুললে চলবে না। শুধু তারা কেন, কেউই এখন পর্যন্ত কমিশনের রিপোর্টকে সাপোর্ট করেনি," বলেন মিজ ফিরোজ।

কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদন বাস্তবায়নের বিষয়ে তিনি জানান, সরকারের নানা পর্যায়ে ছোটখাটো কিছু বিষয়ে সংস্কার কাজ হলেও নারী সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়েই তেমন অগ্রগতি নেই।

"নারীদেরকে সামগ্রিকভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে," বলেন তিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা

রেডিওটুডে নিউজ/আনাম

সর্বশেষ

সর্বাধিক সবার কাছের